Friday 04 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতার প্রথম প্রতিরোধের স্মৃতি নিয়ে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর


২৬ মার্চ ২০১৮ ১০:০৬ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮ ১০:১৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও রাজারবাগ থেকেই শুরু হয়। আর তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর প্রকৃত ইতিহাস জানাতে এবং বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমা ধরে রাখতে গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

২০০৯ সা‌লে তৎকালীন ডিসি মো. হাবিবুর রহমান (বর্তমানে অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক) তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার এ‌কেএম শহীদুল হ‌কের (সদ্য বিদায়ী আই‌জি‌পি) সঙ্গে পরামর্শ করে জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জামা‌দি, বন্দুকসহ নানা দুষ্প্রাপ্য সরঞ্জাম সংগ্রহ শুরু করা হয়।

বিজ্ঞাপন

যা প্রথমে রাজারবাগ টেলিকম ভবনের একটি কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশ যে অকুতোভয় ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে তার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১১’ লাভ করে।

নয় মাসের রক্তাক্ষয়ি সংগ্রামে পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ টেলিকম ভবনে প্রথম জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক।

পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি “জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭”-এর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নব-নির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন। ভবনটি অত্যাধুনিক, সুদৃশ্য ও নান্দনিক অবয়বে নির্মিত হয়েছে। দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির ডিজাইন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত স্থপতি মীর আল-আমিন। ইন্টিরিয়রে ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন রশিদ বনি।

বাংলা‌দেশ পু‌লিশ মু‌ক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থে‌কে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনাবা‌হিনী একযোগে আক্রমণ করেছিল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাজারবাগেই বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রাজারবাগ আক্রান্ত হওয়ার পরপরই বেতারযন্ত্রের অপারেটর মো. শাহজাহান মিয়া নিজ উদ্যোগে ইংরেজিতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের বার্তাটি সারাদেশের পু‌লিশ লাইন ও থানাগুলোতে পাঠিয়েছিলেন।

২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বেতার বার্তায় বলেন, ‘বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলভস, ওভার।’ পুলিশের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন।

পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে প্রাণ হারান শতাধিক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা। রাতেই পাগলা ঘন্টা বা‌জি‌য়ে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করেছিলেন কনস্টেবল আবদুল আলি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল তৎকালীন আইজিপি (প্রয়াত) তসলিম উদ্দিন আহাম্মদসহ ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন। সেই সময়ে সরকারের তথ্য অনুসারে, সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার বাঙালি সদস্য পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে কর্মস্থল ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের একজন ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ডিএসপি, একজন এসডিপিও, ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ ১ হাজার ১০০ জনের বেশি পুলিশ শহীদ হন। এদের মধ্যে রয়েছেন- তৎকালীন রাজশাহীর ডিআইজি শহীদ মামুন মাহমুদ, রাজশাহীর পুলিশ সুপার শহীদ শাহ আবদুল মজিদ, কুমিল্লার পুলিশ সুপার শহীদ কবির উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার শহীদ এম শামসুল হক, পিরোজপুর মহাকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) এবং কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ডক্টর জাফর ইকবালের বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদসহ অনেকে। ত‌বে ৭৫১ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা যে স্থান থেকে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, সেই রক্তাক্ত ভূমিতেই জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে।

এই জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুর্লভ আলোকচিত্রসহ তার শৈশব ও রাজনৈতিক অসাধারণ মুহূর্তগুলো তুলে ধরা হয়েছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে বঙ্গবন্ধু গ্যালারিতে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ১৫টি ছবি র‌য়ে‌ছে। আরও আ‌ছে ভার্চুয়াল লাইব্রেরি ও স্যুভেনিয়র। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রকাশনা, কার্যক্রমসহ পুলিশের আত্মত্যাগের স্মৃতি প্রদর্শিত হয়েছে।

নতুন ভবনের বেইজমেন্টে পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের সব ধরণের স্মৃতি সংরক্ষণ করা র‌য়ে‌ছে। জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বেতার যন্ত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, পাগলা ঘণ্টা, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেল, মর্টারশেলের আঘাতের চিহ্ন এবং মর্টারশেলের অংশবিশেষ, শহিদ কনস্টেবল আব্দুস সালাম এবং জাহাঙ্গীরের সমাধি ফলক, আইজিপি আবদুল খালেকের ভাষণের কপি, সরকারের গার্ড অফ অনার প্রদান, পাটগ্রাম থানা পরিদর্শন মন্তব্য, খেতাবপ্রাপ্ত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ২৫ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ব্যবহৃত রাবার শেল, পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সার্চ লাইট সংরক্ষিত আছে।

এছাড়া ২৫ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ অজ্ঞাত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত সামগ্রী, শহীদ ইন্সপেক্টর গোলাম রাব্বানীর পোশাক, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ শহীদ সদস্যদের ব্যবহৃত বেতের তৈরি ঢাল, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, শার্ট, প্যান্ট, র‍্যাংকব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, এলএমজি, মেশিনগান, এমএম এলএমজি, বোর রিভলবার, বোর শটগান, এমএম এসএমজি, স্বাধীন বাংলার প্রথম আইজিপির ব্যবহৃত চেয়ার, মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর স্মৃতিবিজড়িত তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। ভবনের ওপরে র‌য়ে‌ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পুলিশ সদস্যসহ দেশের সব নাগরিকের কাছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকাসংশ্লিষ্ট কোনো দলিলপত্র, সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, স্মারক, চিঠিপত্র, ছবি, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার্য সামগ্রী, অস্ত্র বা গোলাবারুদের অংশ, ডায়েরি, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি, স্মৃতিস্মারক, পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কিত অপর কোনো তথ্য ইত্যাদি থাকলে সেগু‌লো পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য ‌দি‌লে স্মারকদাতার নাম জাদুঘর‌টি‌তে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হ‌য়ে থা‌কে।

জাদুঘরটি মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শনি থেকে বৃহস্পতিবার খোলা থাকে। শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ থা‌কে। বিশেষ দিবস ছাড়া সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থা‌কে জাদুঘরটি।

বাংলা‌দেশ পু‌লিশ মু‌ক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দা‌য়ি‌ত্বে থাকা পু‌লিশ সুপার (এস‌পি) আ‌বিদা সুলতানা ব‌লেন, সম্পূর্ণ নতুন আ‌ঙ্গিকে বাংলা‌দেশ পু‌লিশ মু‌ক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করা হ‌য়ে‌ছে। জাতীয় চেতনার সা‌থে  ওতপ্রোতভাবে জ‌ড়িত এ প্র‌তিষ্ঠান। প্র‌তিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাতীয় দিবস উৎযাপ‌নের মাধ্য‌মে নতুন প্রজ‌ন্মের কা‌ছে মু‌ক্তিযু‌দ্ধের চেতনা ছ‌ড়ি‌য়ে দিতে বি‌ভিন্ন ধর‌ণের কার্যক্রম প‌রিচালনা ক‌রে আস‌ছে প্র‌তিষ্ঠান‌টি।

২০১৭ সা‌লে প্রথমবা‌রের মতো জাতীয় শিক্ষাক্র‌মে পু‌লি‌শের অবদা‌নের কথা অন্তর্ভু‌ক্তি, প্রথম প্র‌তি‌রোধ যোদ্ধা‌দের রাষ্ট্রীভা‌বে সম্মাননা প্রদান, মু‌ক্তিযুদ্ধ ভি‌ত্তিক গ্রন্থ প্রকাশনা, জাদুঘ‌রে দর্শনা‌র্থী‌দের প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শন আমা‌দের সেই কার্যক্র‌মেরই বহিঃপ্রকাশ।

‌তি‌নি আরও ব‌লেন, স্বাধীনতা দিব‌সের আ‌গে জা‌তির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবুর রহমা‌নের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী ও শিশু দিবস উপল‌ক্ষে শিশু-‌কি‌শোর চিত্রাংকন প্র‌তি‌যো‌গিতা ছাড়াও সপ্তাহব্যা‌পী বই‌মেলার আ‌য়োজন করা হয়। গত বছর ৫টি শিক্ষা প্র‌তিষ্ঠা‌নের অর্ধশত শিক্ষার্থী চিত্রাংকন প্র‌তি‌যো‌গিতায় অংশ নেয়। আর এ বছর ১০টি শিক্ষা প্র‌তিষ্ঠা‌নের আনুমা‌নিক ১২০জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে।

মার্চ মাসকে ঘি‌রে ছিল অ‌নেক কার্যক্রম। ২৪ থে‌কে ২৭ মার্চ ‌বি‌কেল ৩টা থে‌কে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চল‌ছে মু‌ক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চল‌চ্চিত্র প্রদর্শনী। ‌শিক্ষার্থী‌দের জন্য থাক‌ছে বিনা টি‌কি‌টে‌ জাদুঘর দেখার সু‌যোগ। তিনি বলেন, বাংলা‌দেশ পু‌লিশ মু‌ক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ধারণ ক‌রে‌ চ‌লে‌ছে মু‌ক্তিযু‌দ্ধের চেতনা‌কে।

সারাবাংলা/এসআর/আইএ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর