বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় অনিয়ম, ব্যবস্থা নিচ্ছে অধিদফতর
১১ মে ২০২১ ১১:২৬
ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও রেডিক্যাল হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে নানা রকমের অসঙ্গতি পেয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় তদারকি ও নজরদারির জন্য গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটি। অনুমতি না নিয়েই চিকিৎসা দেওয়া, বিল নিয়ে অসঙ্গতি, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেওয়া, ট্রায়াজ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে নমুনা পরীক্ষা নিয়েও নানা অসঙ্গতি পেয়েছে কমিটির সদস্যরা। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে রেডিক্যাল হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসা বন্ধের নির্দেশনাও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। একইসঙ্গে ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে। অতিরিক্ত বিল নেওয়া, মানহীন সেবাসহ রোগীদের পক্ষ থেকে নানা সময় অভিযোগ করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ তদারকি ও নজরদারি করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ৪ মে গঠন করা ওই কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাসহ সাতজন সদস্য রয়েছেন।
৯ মে কমিটির সদস্যরা প্রথমবারের মতো রাজধানীর উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও রেডিক্যাল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
রেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়ে কমিটির সদস্যরা দেখেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই হাসপাতালটিতে কোভিড চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। একইসঙ্গে কোভিড রোগী সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ না করার তথ্যও তারা নিশ্চিত হন। রেডিকেল হাসপাতালে ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট পরিচালনা করার কথা বলা হলেও সেখানে মাত্র একটি ভেন্টিলেটর পাওয়া যায়। দুইটি রুমে পাঁচটি করে বেড স্থাপন আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও এটিকে অনুপযুক্ত বলে মনে করছে কমিটি। একইসঙ্গে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল ছাড়াই সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। সেখানে ম্যানিফোল্ড অক্সিজেন সিস্টেমের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হলেও সেটি ছিল অপর্যাপ্ত। একইসঙ্গে হাসপাতালের সামনে বিপজ্জনকভাবে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখতে পান কমিটির সদস্যরা।
পরিদর্শনকালে কমিটির সদস্যরা রেডিকেল হাসপাতালের বিভিন্ন কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। এ সময় তারা সেখানে ক্যানোলা চার্জ, সার্ভিস চার্জের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত রেটের অতিরিক্ত ফি আদায় করার প্রমাণ পায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন ল্যাবরেটরি নমুনা পরীক্ষাতেও অতিরিক্ত ফি নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। নিজেদের আরটি পিসিআর মেশিন না থাকলেও সেখানে অন্য একটি বেসরকারি টেস্ট সেন্টারের নামে স্থাপন করা একটি নমুনা সংগ্রহ করা বুথ দেখা যায়। এটির কোনো অনুমোদন নেওয়া হয় নাই বলে প্রমাণ পান কমিটির সদস্যরা।
এছাড়াও দেখা যায়, হাসপাতালটিতে কোনো ধরনের ট্রায়াজ সিস্টেম ছাড়াই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালটি যে বিল্ডিংয়ে অবস্থিত সেখানে ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও আছে।
একই দিন উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েও নানা রকমের অসঙ্গতি দেখতে পান কমিটির সদস্যরা। এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও কোনো ধরনের ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা দেখতে পায়নি কমিটি। কোভিড রোগীদের পাশাপাশি নন কোভিড রোগীদের আইসিইউ চিকিৎসা দেওয়ার প্রমাণও তারা পান। ট্রায়াজ ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি হাসপাতালটিতে রক্ত সংগ্রহ করা হয় প্রবেশমুখে স্থাপন করা একটি ডেস্কে। একইসঙ্গে সরকার নির্ধারিত অক্সিজেন বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত ক্যানোলা চার্জ ও সার্ভিস চার্জ আদায়ের প্রমাণও পাওয়া যায়।
পরিদর্শন বিষয়ে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও রেডিকেল হাসপাতালে কিছু অসঙ্গতি দেখতে পাই। পরে তাদের সতর্ক করে আসি। অসঙ্গতির তথ্যগুলো রিপোর্ট আকারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাই, যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) বরাবরও পাঠানো হয়। একইসঙ্গে যে সকল ব্যত্যয় আমরা পেয়েছি সেগুলোর জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞার সই করা এক চিঠিতে উত্তরা রেডিকেল হাসপাতালের কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইসঙ্গে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, যার উত্তর ৩ কর্মদিবসের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে।
ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য কোনো ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সরকারিভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে চিকিৎসা দিয়ে যাওয়ার জন্য। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালেও গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারপরেও নানা রকমের অভিযোগ আসে। সেগুলো দূর করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত নানা বিষয় তদারকি ও নজরদারি করবে। দুইটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে তাদের দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরেও যদি হাসপাতালগুলোতে কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/এসবি/এএম