নেই করোনা চিকিৎসার অনুমতি, অব্যবস্থাপনা নিয়েও বিল লাখ টাকার বেশি
১২ মে ২০২১ ১১:৩৮
ঢাকা: মিজানুর রহমান (ছদ্মনাম)। বাড়ি গাজীপুর। নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের পর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসেন। শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের সংক্রমণ থাকায় প্রথমে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে না পেরে যান কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। ওইখানেও তিনি ভর্তি হতে পারে না। তবে সেখান থেকে তাকে একজন জানায় উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের রেডিক্যাল হাসপাতালে সিট খালি আছে। এমনকি তিনিই মিজানুর রহমানকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ছয়দিন চিকিৎসা শেষে বিল আসে ২ লাখ ৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে অক্সিজেন বিল বাদ ৫১ হাজার টাকা ও আইসিইউ বেড ভাড়া রাখা হয় ৬০ হাজার টাকা।
মিজানুর রহমানের ভাই মশিউর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাইকে বলা হয়েছে আইসিইউতে রাখার কথা। কিন্তু সেখানে তেমন কোনো সুবিধাই ছিল না। খোপ খোপ ঘর করে কয়েকটি বেড রেখে সেটাকে আইসিইউ বানিয়েছে তারা। এমন আইসিইউ আর কখনও দেখিনি। এছাড়া সেখানে তেমন কোনো ডাক্তারও ছিল না। কিন্তু দেখা গেছে প্রতিদিনই ডাক্তারের ভিজিটের নামে বিল করেছে। আর এই টেস্ট, সেই টেস্ট মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকার বিল। ভাইয়ের করোনা তাই কিছু বলিনি। তারা যা বলেছে আমাদের তাই বিশ্বাস করতে হয়েছে।’
১ মে থেকে রেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি হন রাজীব চৌধুরী (ছদ্মনাম)। ছয়দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তার বিল আসে এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মাঝে দুদিন ছিলেন হাসপাতালের এইচডিইউতে। যার বিল রাখা হয় ১৪ হাজার টাকা। আর আইসিইউতে চারদিনের জন্য বিল করা হয় ৪০ হাজার টাকার। সার্ভিস চার্জ বাবদ রাখা হয় ১৭ হাজার ৫৫৭ টাকা। সেই সঙ্গে হাই-ফ্লো নজল ক্যানোলা বাবদ রাখা হয় পাঁচ হাজার টাকা।
রেহানা ইসলাম (ছদ্মনাম) নামে আরেকজন উত্তরার রেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি হন ১২ এপ্রিল। ২ দিন তিনি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তার বিল আসে ৫৩ হাজার টাকা।
সরেজমিনে রেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একই বিল্ডিংয়ে আছে ব্যাংক, ফার্মেমিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের প্রবেশমুখে রোগীদের জন্য নেই কোনো ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা। হাসপাতালের সামনেই ফেলে রাখা হয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে জানা যায় প্রতিষ্ঠানটিতে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি। এছাড়া ৩০০ জনের বেশি রোগীকে করোনা চিকিৎসা দেওয়া হলেও এর কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট দফতরে কখনও দেওয়া হয়নি। আর ১০ বেডের যে আইসিইউ ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেটা নিয়ে রয়েছে অভিযোগ। অপ্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি পরীক্ষার দাম বেশি রাখার অভিযোগও আছে এই হাসপাতালে বিরুদ্ধে। অনুমতি না থাকলেও এই হাসপাতালে একটি বুথ বসিয়ে নমুনা পরীক্ষাও করা হতো। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীও।
বিভিন্ন সময় এখানে চিকিৎসা নেওয়া রোগী ও তাদের স্বজনদের পক্ষ থেকে করা এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় সরেজমিনে গিয়ে। তবে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেডিক্যাল হাসপাতালের ম্যানেজার আমজাদ হোসেন রিয়াদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ১০ ইউনিটের একটি কোভিড-১৯ চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। সেখানে পাঁচটি আইসিইউ আছে। যাদের লাইফ সাপোর্ট লাগে না তাদের হাই-ফ্লো নজল ক্যানোলা লাগে। আমাদের তেমন চারটা হাই-ফ্লো নজল ক্যানোলা থাকায় সেগুলোকে আইসিইউ বেড হিসেবে বিল রাখা হয়। হাই-ফ্লো নজল ক্যানোলা না লাগলে আমরা এইচডিইউ হিসেবে বিল করি।’
প্রতিষ্ঠানটিতে দুটি ভ্যান্টিলেটর থাকার কথা উল্লেখ করলেও তার মাঝে একটি নষ্ট বলে জানান আমজাদ হোসেন রিয়াদ। হাসপাতালের সামনে অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেলে রাখা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আগে বেশি অক্সিজেন লাগতো না। কিন্তু করোনা বেড়ে যাওয়ার আমরা চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন আনা শুরু করি। এ কারণে সেখানে কিছু অক্সিজেন সিলিন্ডার পড়ে ছিল।’
পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা না নিয়ে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া ছাড়া কোভিড-১৯ চিকিৎসা বিষয়ে আমজাদ হোসেন রিয়াদ বলেন, ‘আমাদের এখানে ১০ বেডের যে সেটআপ তা দিয়ে একটি ইউনিট আলাদা করেছি। দুজন ডাক্তার ও নার্স দিয়ে আমরা এটা শুরু করি।’ তবে বেশি বিল নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হাসপাতাল ম্যানেজার। তিনি বলেন, ‘আপনি হাসপাতালে আসেন। আমরা সামনা-সামনি কথা বললে ভালোভাবে বোঝাতে পারব।’
এদিকে ৯ মে হাসপাতালটিতে পরিদর্শনে যান বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি ও নজরদারি জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত কমিটির সদস্যরা। তারা গিয়ে সেখানে বিভিন্ন ব্যত্যয় দেখতে পান। সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত মূল্য রাখা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের চাইতেও বেশি নেওয়ার প্রমাণ পায় কমিটি। সেই সঙ্গে অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠানটি কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থা চালানোর তথ্য পায় এই কমিটি।
কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়ে আমরা কিছু অসঙ্গতি দেখতে পাই ও তাদের সতর্ক করে আসি। পরবর্তী সময়ে আমরা অসঙ্গতির তথ্যগুলো রিপোর্ট আকারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাই, যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) বরাবরও পাঠানো হয়েছে। সেইসঙ্গে যে সব ব্যত্যয় আমরা পেয়েছি সেগুলোর জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।’
পরবর্তী সময়ে এই কমিটির ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞার সই করা এক চিঠিতে উত্তরা রেডিক্যাল হাসপাতালের কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধ পরিকর। আর এজন্য কোনো ধরণের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সরকারিভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে চিকিৎসা দিয়ে যাওয়ার জন্য। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালেও গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারপরেও নানারকমের অভিযোগ আসে। আর সেগুলো দূর করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত নানা বিষয় তদারকি ও নজরদারি করবে। এই কমিটি দুটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। তাদের সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরেও যদি হাসপাতালগুলোতে কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় তবে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ৪ মে বেসরকারি হাসপাতালসমূহের কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি ও নজরদারির জন্য ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সাত সদস্যের এই কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা রয়েছেন।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম
নেই করোনা চিকিৎসার অনুমতি বিল লাখ টাকার বেশি রেডিক্যাল হাসপাতাল