শিশুকে টিউমারের রোগী সাজিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, ৪ বছর পর ধরা!
১২ মে ২০২১ ২৩:৪৪
ঢাকা: শিশুটির মাথায় ব্যান্ডেজ ও হাতে ক্যানোলা। এই শিশুকে দেখিয়েই তার মা বলে, মাথায় টিউমার ছিল। অপারেশন হয়েছে। এখন ওষুধ কেনার টাকা নাই— প্রায় চার বছর ধরে এভাবেই ঢাকা কলেজ ও ইস্টার্ন মল্লিকা এলাকায় ভিক্ষা করছেন কামরুন্নাহার (৩০)। আর তার ভিক্ষাবৃত্তির হাতিয়ার নিজের তিন বছর বয়সী শিশু শারমিন নাহার।
অন্যান্য দিনের মতো বুধবারও (১২ মে) কামরুন্নাহার তার শিশুটিকে নিয়ে ইস্টার্ন মল্লিকার সামনে ভিক্ষা করছিল। আর সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন নারায়নগঞ্জের বাসিন্দা সাদিয়া কবির। এক পর্যায়ে সে কামরুন্নাহারকে দেখে চিনে ফেলে। এবং শিশুটির মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে জিজ্ঞাসা করে, তার কী হয়েছে? কামরুন্নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, তার মাথায় টিউমার হয়েছিল। ২৭ দিন আগে মাথায় অপারেশন করা হয়েছে। আজকেও ড্রেসিং করা হয়েছে। কিন্তু ওষুধ কেনার টাকা নেই।
সন্দেহ হয় সাদিয়ার। তিনি তখন বলেন, ‘ওষুধ কেনার সব টাকা আমি দেবো। কিন্তু তার আগে ওর মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেখব কী অবস্থায় আছে।’ সাদিয়ার এই প্রস্তাবে রাজি হন না কামরুন্নাহার। তাদের অবস্থা দেখে আরেক নারী মোহিনী আক্তার এগিয়ে যান তাদের কাছে। তার বাসাও ঢাকা কলেজের পেছনে। তিনিও প্রায় প্রতিদিনিই কামরুন্নাহারকে ঢাকা কলেজের সামনে শিশুটিকে নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখেন।
এক পর্যায়ে সাদিয়া ও মোহিনী মিলে শিশুটির মাথার ব্যান্ডেজ খুলে অস্ত্রোপচারের জায়গাটির বর্তমান অবস্থা দেখতে চান। শিশুটিকে নেওয়া হয় হাতিরপুলের এক ফার্মেসিতে। সেখানে ব্যান্ডেজ খুলতে রাজি হন না কামরুন্নাহার। জানান এমবিবিএস ডাক্তার লাগবে। তখন মোহিনী তার আত্মীয় এক ডাক্তারকে ফোন করেন। ডাক্তার তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। পরে দুপুরে সাদিয়া ও মোহিনী আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে কামরুন্নাহারের শিশুটির ব্যান্ডেজ খুলতে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।
কামরুন্নাহারসহ শিশুটিকে নেওয়া হয় হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের ৯৮ নম্বর কক্ষে। সেখানেই খুলে দেখা হবে শিশু শারমিন নাহারের মাথার কী অবস্থা। ৯৮ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায় বেশকয়েকজন লোকের ভিড়। এদের মধ্যে কেউ কেউ কামরুন্নাহারের পক্ষে কথা বলছেন, আবার কেউ তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা নারীর পক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু শিশুটির মাথার ব্যান্ডেজ খুলতে রাজি হচ্ছিলেন না কামরুন্নাহার।
এক পর্যায়ে তিনি কান্না জুড়ে দেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘২৭ দিন আগে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে অপারেশন হয় শিশুটির। ডাক্তার আলিম তার শিশুকে অপারেশন করেন।’ মাথার ব্যান্ডেজ নতুন কেন— জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘সকালে ড্রেসিং করানো হয়েছে।’
কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না কামরুন্নাহার। পরে বলতে গেলে জোর করেই শিশুটির মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়। খোলার পর দেখা যায়, শিশুটির মাথায় কোনো অপারেশন বা ক্ষতের দাগ নেই। পরে কামরুন্নাহার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ভিক্ষাবৃত্তির কথা স্বীকার করেন। জানান, তার আরও দুই সন্তান আছে। স্বামী জাকির রিকশা চালান। থাকেন কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। তিন ছেলে-মেয়েসহ স্বামীকে নিয়ে সংসার চালানো কঠিন। তাই এই পথ বেছে নিয়েছেন। পরে কামরুন্নাহারকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দেন সাদিয়া ও মোহিনী।
এসময় কথা হয় সাদিয়ার ও মোহিনীর সঙ্গে। সারাবাংলাকে সাদিয়া বলেন, ‘আমি সিটি কলেজে পড়ালেখা করি। ২০১৯ সালে কলেজে যাতায়াতের সময় কামরুন্নাহারকে দেখতাম কলেজের আশেপাশে ভিক্ষাবৃত্তি করতে। তখনো শিশুটির মাথায় ব্যান্ডেজ ছিল। হাতে ক্যানোলাও লাগানো থাকত। সেই অবস্থা আজকেও দেখছি। সেজন্যই আমার সন্দেহ হয়। তিনি শিশুটিকে পুঁজি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। তাই তাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। শুধু সত্যটা জানার জন্য হাসপাতাল পর্যন্ত এসেছি।’
সারাবাংলাকে মোহিনী আক্তার বলেন, ‘কামরুন্নাহারকে আমিও অনেক দিন ধরে ঢাকা কলেজ এলাকায় শিশুটিকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখছি। আমারও মাঝে-মধ্যে সন্দেহ হতো। আজ সন্দেহ দূর করতে সাদিয়ার সঙ্গে ওদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। শুধু সত্যটা জানাই ছিল উদ্দেশ্য।’
সাদিয়া ও মোহিনী হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় বলেন, মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করতেই পারে। তাই বলে এভাবে নিজের শিশুটি মাথায় ব্যান্ডেজ ও হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে প্রতারণা! মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে কিভাবে!
সারাবাংলা/এসএসআর/পিটিএম