পরকীয়া নাকি আরও কিছু— খুনের মোটিভেই সর্বোচ্চ নজর
১৩ মে ২০২১ ২২:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। খুনের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বেশকিছু তথ্য, টাকা লেনদেনের প্রমাণ এরই মধ্যে পেয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু কী কারণে এই খুন অর্থাৎ খুনের মোটিভ কী, সেটি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়ার দিকেই এখন সর্বোচ্চ নজর পিবিআইয়ের।
মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন মামলার এজাহারে দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এক নারীর সঙ্গে বিয়ে বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কের জেরে দাম্পত্য কলহ থেকেই মিতুকে খুন করিয়েছেন বাবুল আক্তার। পিবিআই এরই মধ্যে বাবুল আক্তার এবং ওই নারীর মধ্যে সম্পর্কের কিছু তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে। বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ, কক্সবাজারে ওই নারীর কর্মস্থলে গিয়ে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ এবং তিনি বাংলাদেশে আছেন কি নেই— এ বিষয়ে তদন্ত ও সবশেষ তার সঙ্গে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে খুনের মোটিভ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত হতে চায় পিবিআই।
পিবিআইয়ের তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোশাররফ হোসেনের অভিযোগের বাইরে উল্লেখযোগ্য আর কোনো কারণ আছে কি না, যার কারণে স্ত্রী হত্যার মতো অপরাধের সঙ্গে একজন সাবেক পুলিশ সুপার জড়িয়ে যেতে পারেন— এ বিষয়টিও তারা খতিয়ে দেখবেন। তাদের মতে, খুনের মোটিভ চূড়ান্ত হলেই এ মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। এরপর বাবুল আক্তারের সঙ্গে কিলিং মিশনে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্ক এবং হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হবে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুনের মোটিভ— এটি এই মামলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তথ্যপ্রমাণ, আলামত সংগ্রহ এবং আসামি ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে আমরা এই মোটিভ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হতে চাই। সেটি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি।’
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এরপর মামলার তদন্তে গতি আসে। ১৫ মাস পর গত ১১ মে বাদী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয় পিবিআই। তবে এর আগেই ঘটনার সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। পরদিন আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় বাবুল আক্তারের মামলার।
এরপর মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে নতুনভাবে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আরও সাত জন আসামি আছেন। তারা হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়া।
মোশাররফ হোসেনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বুধবার (১২ মে) বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করে পিবিআই। আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাবুল আক্তারকে পিবিআই হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের পর শুরুতে মোশাররফ হোসেন জামাতা বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। বরং তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু একবছর পর থেকে সুর পাল্টান, বাবুলকে হত্যার জন্য সন্দেহ করে বক্তব্য দিতে থাকেন গণমাধ্যমে।
সর্বশেষ পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে মোশাররফ অভিযোগ করেন, কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন বাবুল আক্তার আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র কর্মকর্তা ভারতীয় নাগরিক গায়ত্রী অমর শিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি জেনে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তাকে তাকে খুনের পরিকল্পনা করেন এবং সহযোগীদের নির্দেশ দিয়ে মিতুকে খুন করান।
এজাহারে আরও বলা হয়, বাবুল আক্তারের মোবাইলে পাঠানো গায়ত্রীর ২৯টি মেসেজ খুনের শিকার হওয়ার আগে মিতু তার ব্যবহৃত একটি খাতায় লিখে যান। এছাড়া বাবুল আক্তারকে গায়ত্রীর উপহার হিসেবে দেওয়া দু’টি বইয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের কিছু লিখিত তথ্যপ্রমাণ আছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গায়ত্রীর ২৯টি মেসেজ লেখা মিতুর খাতা ও বাবুলকে উপহার হিসেবে দেওয়া দু’টি বই তারা আলামত হিসেবে জব্দ করেছেন। কিন্তু মেসেজগুলো গায়ত্রীর কি না এবং বইয়ে যেসব হাতের লেখা আছে সেগুলো বাবুল আক্তারের কি না, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বাবুল আক্তারকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া বিষয়টি নিশ্চিতে প্রযুক্তিরও ব্যবহার করা হবে।
‘বাদী এজাহারে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ করেছেন প্রধান আসামির বিরুদ্ধে। যদিও আমরা কিছু তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি, কিন্তু আদৌ সেগুলো সঠিক কি না এবং বাদীর অভিযোগের সত্যতা আছে কি না, সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব। এক্ষেত্রে আরও তথ্যপ্রমাণ আমাদের সংগ্রহ করতে হবে,’— বলেন সন্তোষ কুমার চাকমা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গায়ত্রীকে সরাসরি আসামি করা না হলেও মামলার এজাহার তার বিষয়টি উল্লেখ আছে। সেক্ষেত্রে বাদীর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে এবং খুনের মোটিভ নিশ্চিতে তার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। তবে সেটি করতে হবে গায়ত্রীর মেসেজ ও বইয়ে থাকা তথ্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিতের পর।
সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘আমরা যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি যে গায়ত্রীর সঙ্গে মামলার প্রধান আসামির বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তখন আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। গায়ত্রীর সঙ্গে কথা বলাটা সেক্ষেত্রে জরুরি হবে। আমরা কক্সবাজারে উনি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন, সেখানে গিয়ে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করব। অথবা প্রধান আসামির তৎকালীন কর্মস্থলে গেলেও হয়তো আমরা তথ্য পাব। গায়ত্রী বর্তমানে বাংলাদেশে আছেন কি নেই, সেটি খুঁজে বের করব। অথবা তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, যোগাযোগের চেষ্টা আমাদের থাকবে।’
তবে বাদীর অভিযোগের বাইরে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আরও কোনো কারণ আছে কি না, সেটিও তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খুনের মোটিভের পাশাপাশি বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে মামলায় আরও যে সাত জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কিভাবে হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে কার কিভাবে, কতটুকু সম্পৃক্ততা ছিল এবং সেক্ষেত্রে বাবুল আক্তারের ভূমিকা কী ছিল— এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গত ১১ মে বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠজন ও ব্যবসায়িক পার্টনার সাইফুল হক এবং তার ঘনিষ্ঠজন গাজী আল মামুন আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সাইফুল হক জানিয়েছেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর তিনি বাবুল আক্তারের নির্দেশে গাজী আল মামুনের মাধ্যমে মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসাকে তিন লাখ টাকা দেন। গাজী আল মামুন সেই মুসার আত্মীয়। মামুনও জবানবন্দি দিয়ে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানিয়েছেন, বিকাশের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ তারা পেয়েছেন। সাইফুল ও মামুনের জবানবন্দি এবং টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পাবার পর মোটামুটিভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তারের ‘একটি যোগসূত্র’ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘প্রধান আসামির সঙ্গে অন্যান্য আসামিদের কানেক্টিভিটি— এটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে বের করতে হবে। হত্যাকারীদের সঙ্গে ভিকটিমের স্বামীর যোগাযোগটা কিভাবে হলো, কেন হলো, এগুলো বের করতে হবে। খুনের মোটিভ আর আসামিদের পরস্পরের মধ্যে কানেক্টিভিটি বের করতে পারলে পুরো রহস্য উন্মোচন হবে।’
এর আগে ঢাকায় পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারও এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঘটনাস্থলের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভির ফুটেজে একজনকে দেখা গিয়েছিল। পরে জানা যায় সে বাবুল আক্তারের ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা। ভিডিও ফুটেজ স্পষ্ট মুসাকে চেনা গেছে। কিন্তু তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে মুসাকে নিয়ে বাবুল আক্তার কোনো সন্দেহের কথা বলেনি। পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি যে বাবুল আক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে নিয়ে পুলিশকে কিছু জানায়নি।’
মুসাকে কেন বাবুল আক্তার আড়ালের চেষ্টা করেছেন, সেটি নিয়েও বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এদিকে, বুধবার (১২ মে) রাতে গ্রেফতার হওয়া মুসার ভাই সাইদুল আলম শিকদার সাক্কুকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাক্কুকে বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন তদন্তে যুক্তরা।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর