মহামারির জনপদে ঈদ: উদযাপন হোক, উৎসবটা তোলা থাক
১৪ মে ২০২১ ০১:২০
বছর পেরিয়ে গেছে। তবে মহামারি থামেনি। বরং থেকে থেকেই বাড়ছে তার তীব্রতা। জনপদে তাই ফেরেনি স্বস্তি। জনজীবন এখনো অস্বাভাবিক। কেতাবি ভাষায় অবশ্য বলা হয় ‘নিউ নরমাল’। সেই ‘নিউ নরমাল’ বাস্তবায় কেটেছে দুইটি ঈদ উৎসব। অবশ্য ঘরবন্দি পরিস্থিতিতে সে আয়োজন প্রকৃত অর্থে উৎসবে রূপ নিতে পারেনি। এখন দুয়ারে আরও এক ঈদ।
হ্যাঁ, একমাসের সিয়াম সাধনা শেষ হয়েছে। দুয়ারে ঈদুল ফিতর। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু গত বছর যে পরিস্থিতিতে হাজির হয়েছিল ঈদুল ফিতর, একই পরিস্থিতি এবারেও। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের দিক থেকে পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে বেশি নাজুক। তবু ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি— সেই খুশি আর আনন্দের রেশ তো আছেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতর শুরু থেকেই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে আসছে প্রতিদিন। তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক, গত বছরের ঠিক এই সময়ে পরিস্থিতি কেমন ছিল। এ বছরের সবশেষ চার দিনে (১০ থেকে ১৩ মে) করোনায় মৃত্যু ছিল ৩০-এর ঘরে। শনাক্তের পরিমাণ ছিল ১১শ থেকে দেড় হাজারের মতো। গত বছরের একই সময়ে সংক্রমণ ছিল হাজারের কিছু কমবেশি। চার দিনের মধ্যে একদিনে সর্বনিম্ন ১১ ও সর্বোচ্চ ১৯ জন মারা যান। স্পষ্টতই গত বছরের চেয়ে সংক্রমণ-মৃত্যুর সংখ্যা এ বছর বেশি।
তবে কেবল সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করলে চলবে না। গত বছর যখন ঈদুল ফিতর এলো, তখন দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের মাত্র দুই মাস পার হয়েছে। সারাবিশ্বেই করোনা সংক্রমণের তখন চলে পাঁচ মাস। সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা বিশ্বের জন্যই। দেশে তখন সাধারণ ছুটি চলছিল। ছিল নানা ধরনের বিধিনিষেধও। সেই ঈদও স্বাভাবিকভাবেই কেটেছে ঘরে।
এ বছর স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় পরিস্থিতি আরও একটু প্রতিকূল হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এ বছর সংক্রমণ বেশি, মৃত্যুও বেশি। তবে এ বছরের মার্চে ফের করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ফিরে আসে। তাতে একদিনে সাত হাজারেরও বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে দেশে। একদিনে শতাধিক মৃত্যুরও সাক্ষী হয়েছে দেশ। তবে বছরখানেক ধরে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে থাকার কারণেই হয়তো মানুষের মধ্যে এক ধরনের অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে। আর শুরু থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের বিভ্রান্তি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এই মহামারিতেও ঈদকে ঘিরে যে কার্যক্রম চলছে, তা যথেষ্টই উদ্বেগজনক। তাতে করে ঈদ মানে খুশি হলেও সেই আনন্দ বিষাদে রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
গত ৫ এপ্রিল থেকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার জারি করে বিধিনিষেধ। ১৪ এপ্রিল থেকে জারি করা হয় আরও কঠোর বিধিনিষেধ। বন্ধ করা হয় যানচলাচল। বন্ধ করা হয় দোকানপাট। শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে গণপরিবহন, দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়। তাতে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। দূরপাল্লার যানচলাচল বন্ধ হলেও অনেকেই নানা কৌশল করে বাড়ি ফিরেছেন। ফেরি ঘাটে দেখা গেছে হাজারও মানুষের ঢল।
এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক নিজেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন— ঈদে অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউও দেখা দিতে পারে। ঈদের আগের শেষ কয়েকদিনের চিত্র বলছে, এমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।
সাধারণ মানুষের এমন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও ছিল সমালোচনা। জেলার মধ্যে গণপরিবহনকে সীমাবদ্ধ না করে বরং দূরপাল্লার গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে গুরুত্ব দিলেই সেটি বেশি কার্যকর হতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার স্বাস্থ্য অধিদফতর সংক্রমণ এড়াতে বদ্ধ স্থানের পরিবর্তে খোলা ময়দানে ঈদ জামাত আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বরং মাঠে ঈদ জামাত আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ঈদ জামাতের আয়োজন করতে বলা হয়েছে মসজিদে।
করোনা সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে এমন সব বৈপরীত্য নিয়েই হাজির ঈদ। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দু’জনেই উদযাপনে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একই আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও।
এদিকে, রাজধানী ঢাকায় ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাতসহ মোট পাঁচটি জামাত হবে বায়তুল মোকাররমে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, জাতীয় মসজিদে সকাল ৭টায় হবে প্রথম জামাত। এরপর সকাল ৮টা, ৯টা ও ১০টায় হবে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ জামাত। আর শেষ জামাতটি হবে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে।
করোনা মহামারি হোক আর যাই হোক, শেষ পর্যন্ত দুয়ারে তো ঈদ। ঈদের যে আনন্দ, মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেটুকুই সবাই উপভোগ করার চেষ্টা করি, প্রত্যাশা থাকুক এটুকুই। সময় যেহেতু স্বাভাবিক নেই, ফলে ঈদের উদযাপন-আয়োজনও স্বাভাবিক থাকবে না— এই বাস্তবতাটুকু ধারণ করি সবাই। ঈদ আনন্দে অসতর্কতা যেন ঈদ পরবর্তী সময়ে দুর্ভোগ বয়ে না আনে, সেদিকে নজর দেই। সতর্ক হয়ে ঈদের উদযাপনটা করি, উৎসবটা না হয় তোলা থাক পরের জন্য।
এবং সব কথার শেষ কথা— মাস্ক পরি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। ঈদ মোবারক।
লেখক: অ্যাক্টিং নিউজ এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট
সারাবাংলা/টিআর