আ.লীগ নেতার প্রত্যয়নে ৫ মামলায় জামিন নিয়ে হেফাজত নেতার মুক্তি
১৪ মে ২০২১ ১৪:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংস তাণ্ডবের ঘটনায় গ্রেফতার এক হেফাজত নেতার পাঁচ মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া নিয়ে তোলপাড় তৈরি হয়েছে। ওই হেফাজত নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মর্মে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন দলটির উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। সেই প্রত্যয়নপত্র জামিন আবেদনের সঙ্গে আদালতে দাখিল করা হয়। এর ফলে ‘রাষ্ট্রপক্ষের জোরালো বিরোধিতা না থাকায়’ সহজেই জামিন পেয়ে যান ওই ব্যক্তি। জামিননামা কারাগারে পৌঁছানোর পর নিয়মমাফিক মুক্তিও পেয়ে যান।
কিন্তু গ্রেফতারের মাত্র একমাসের মধ্যে থানায় আক্রমণসহ সহিংসতার মামলার আসামি হেফাজত নেতার জামিন ও মুক্তি নিয়ে বিস্মিত হন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। পুলিশ জেলগেট থেকে আবারও ওই হেফাজত নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎপর হন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও। তিনি পাঁচ মামলায় জামিন বাতিলের আবেদন করেন। আদালত ভার্চুয়াল শুনানি সম্পন্ন করে তার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
আজ শুক্রবার (১৪ মে) ঈদের দিনেও চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল আদালতে উপস্থিত হয়ে পরোয়ানায় সই করেন। বেঞ্চ সহকারীর মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয় হাটহাজারী থানায়।
পুলিশ জানিয়েছে, উজায়ের আহমেদ হামিদী নামে ওই ব্যক্তি হেফাজতে ইসলামের হাটহাজারী উপজেলা শাখার দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক। তিনি হাটহাজারী পৌরসভার ৪ নম্বর আলীপুর ওয়ার্ডের বড় মৌলভী বাড়ির প্রয়াত জুনায়েদ আহমদের ছেলে। পুলিশ বলছে, উজায়েরের হেফাজত ছাড়া অন্য কোনো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চাইলে সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান বলছেন, উজায়ের যুবলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতিই করেন। হেফাজতের রাজনীতিতে তিনি যুক্ত কি না, তা জানেন না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে গত ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় তাণ্ডব চালান হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় মোট ৯টি মামলা দায়ের হয়। উজায়ের আহমেদ হামিদীকে হাটহাজারী থানা পুলিশ গত ১২ এপ্রিল গ্রেফতার করে। পাঁচটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. মোর্শেদ সারাবাংলাকে জানান, গত ৬ মে উজায়ের চার মামলায় জামিনের আবেদন করেন। তার জামিন আবেদনের সঙ্গেই ছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতয়নপত্র। রাষ্ট্রপক্ষের জোরালো বিরোধিতা না থাকায় চার মামলায় তিনি জামিন পান। ৯ মে চার মামলার জামিননামা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ঈদের বন্ধ শুরুর আগের দিন বুধবার (১২ মে) সকালে আরেকটি মামলায় তিনি জামিন পান। দুপুরের মধ্যে ওই জামিননামাও কারাগারে পাঠানো হয়।
পুলিশ ও আদালতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উজায়েরের জামিনের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর জেলা পুলিশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা পিপি আ ক ম সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, উজায়েরের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি মিথ্যা। ওই দিনই (বুধবার) দুপুর ২টার দিকে তিনি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে উজায়েরের পাঁচ মামলার জামিন বাতিলের আবেদন করেন। বিকেল ৩টায় জেলা ও দায়রা জজ ভার্চুয়ালি আদালতের কার্যক্রম শুরু করেন। শুনানি করেন পিপি। আদালত জামিন বাতিল করে পাঁচ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মুক্তির পর তাকে হেফাজতে নেয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার তারিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচটি মামলায় আমরা জামিননামা হাতে পাই। সেখানে জেলা জজের স্বাক্ষরসহ সূত্র নম্বর, স্মারক নম্বর সবই ছিল। এরপর আমরা যেখানে যেখানে অবহিত করার নিয়ম আমাদের রয়েছে, সেখানে অবহিত করি। আর কোনো মামলা না থাকায় আমরা তাকে বৃহস্পতিবার (১৩ মে) বিকেল ৪টায় মুক্তি দিই। কারাগার থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’
জানতে চাইলে জেলা পিপি আ ক ম সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন দায়িত্বশীল আওয়ামী লীগ নেতা সনদ দিয়ে বলেছেন, উজায়ের আহমেদ হামিদী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সেটা স্বাভাবিকভাবেই আমি বিবেচনায় নিয়েছি। কিন্তু পরে জানতে পারি, সনদটি ভুয়া। সে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। সে একজন হেফাজতের সন্ত্রাসী। আমি আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো সনদ তিনি দেননি। তখন আমি জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য বিশেষ আবেদন করি। আদালতে শুনানির সময় আমি জোরালোভাবে এ বিষয়ে বক্তব্য দিই। আদালত আমার যুক্তি শুনে জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।’
বেঞ্চ সহকারী মো. মোর্শেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার স্যার (জেলা ও দায়রা জজ) কোর্টে আসতে পারেননি। আজ (শুক্রবার) ঈদের দিন সকালেই স্যার কোর্টে এসেছেন। পাঁচটি গ্রেফতারি পরোয়ানায় সই করেছেন। স্যারের নির্দেশে আমি নিজেই সেগুলো হাটহাজারী থানায় নিয়ে জমা দিয়েছি। হাটহাজারী থানায় হেফাজতে ইসলামের ঘটনা নিয়ে দায়ের হওয়া মামলায় আমাদের আদালতে কমপক্ষে ১০০টি শুনানি হয়েছে। একজনও জামিন পাননি। শুধু উনিই (উজায়ের) পেয়েছিলেন। আবার সেটা বাতিলও হয়েছে।’
পাঁচ মামলার প্রতিটিতে উজায়েরের পক্ষে জামিন আবেদনের সঙ্গে হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্যাডে সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমানের সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বেঞ্চ সহকারী মো. মোর্শেদ। ১ এপ্রিল তারিখে সই করা ওই প্রত্যয়নপত্রে লেখা আছে— উজায়ের আহমেদ হামিদী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সবসময় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে হাটহাজারী পৌরসভা আওয়ামী লীগের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা। আমরা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।
জানতে চাইলে সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার কথা সারাবাংলার কাছে স্বীকার করেন। তিনি জানিয়েছেন, উজায়ের আহমেদ হামিদী হাটহাজারী পৌরসভা আওয়ামী লীগের ৪ নম্বর ওয়ার্ড শাখার কোষাধ্যক্ষ পদে আছেন।
সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সার্টিফিকেট দিয়েছি। উজায়ের হেফাজতে ইসলাম করে কি না, সেটি আমার জানা নেই। তবে আমি জানি, সে ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতি করেছে। এখন আওয়ামী লীগ করে। গ্রেফতারের সাত দিন আগেও সে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। সে হাটহাজারী মাদরাসায় পড়ালেখা করেছে। কিন্তু সে আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় নেতা। আমি ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আছি। আমি জানি, হাটহাজারীতে কে ছাত্রলীগ করে, কে যুবলীগ করে আর কে আওয়ামী লীগ করে। আমার চেয়ে এটা বেশি কেউ জানবে না।’
জেলা পিপি আ ক ম সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে তিনি (সোহরাব) অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি কোনো সনদ দেননি। আমি তো আর উজায়ের আহমেদকে চিনি না।’
জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘উজায়ের আহমেদ হামিদী হেফাজতে ইসলামের হাটহাজারী উপজেলা শাখার দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক। এর বাইরে উনি কোনো রাজনীতি করেন কি না, আমাদের জানা নেই। হাটহাজারীতে তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উনি জামিন নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছে। এখন আমরা আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে আইনি পদক্ষেপ নেব।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর