রাজনৈতিক বিবেচনায় বিমা কোম্পানির অনুমোদন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
১৫ মে ২০২১ ০৮:২৩
ঢাকা: দেশে চাহিদার তুলনায় বিমা কোম্পানির পরিমাণ বেশি থাকলেও একের পর এক নতুন বিমা কোম্পানির অনুমোদন দিচ্ছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান টানা তিন মেয়াদে নিবন্ধন পেয়েছে মোট ১৯টি বিমা কোম্পানি। এর মধ্যে চলতি মে মাসেও নিবন্ধন পেয়েছে দুইটি কোম্পানি। বিমা খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রয়োজন না থাকলেও কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই বিমা কোম্পানির সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। পুরনো কোম্পানিগুলোই ঠিকমতো ব্যবসা করতে না পারায় গ্রাহকের পলিসির টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। অনেক কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন ভেঙে খাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন বিমা কোম্পানির নিবন্ধন অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেতে রূপ নিতে পারে।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা অর্থনীতি চালাচ্ছি হুজুগে। প্রয়োজন ছাড়াই কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। কেবল রাজনৈতিক কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হলে আমাদের আর কী বলার থাকে!
সুনির্দিষ্টভাবে বিমা কোম্পাানির কথা তুলে ধরে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, বর্তমানে যেসব বিমা কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোই ঠিকমতো চলতে পারছে না। বিমার রেগুলেটরের বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় নতুন বিমা কোম্পানি অনুমোদন দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা ছিল বলে আমার মনে হয় না।
বিমা খাতের অবস্থা সুখকর না হলেও সরকার কেন নতুন কোম্পানি অনুমোদন দিচ্ছে এবং নতুন কোম্পানির উদ্যোক্তারাই বা কেন এই খাতে আসছেন— জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজ বলেন, এটি স্রেফ অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাব, এর পেছনে এটা অর্থনীতিরি সেন্সের অভার, কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখাও নেই। মন্দা অর্থনীতির মধ্যেও যারা নতুন বিমা কোম্পানির নিবন্ধন নিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। হয়তো তারা বিমার প্রিমিয়াম নিয়ে ক্লেইম সেটেল করবে না (বিমার প্রিমিয়াম গ্রাহকের কাছ থেকে নিলেও গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধ করবে না। গ্রাহকের টাকা আত্নসাৎ করার কোনো দুরভিসন্ধি তাদের রয়েছে কি না— সে প্রশ্নও উঠতেই পারে।
দেশের বিমা খাতকে ‘অসুস্থ’ বলে অভিহিত করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদি ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে বিমার বাজারই নেই, আছে শুধু কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনোটিই বাজার তৈরিতে মনোযোগী নয়। বাংলাদেশে বিমার বাজারের আকার যেখানে এক শতাংশের চেয়েও কম, সেখানে ৮১টি বিমা কোম্পানি থাকা অসুস্থতা। অনেক দেশে জিডিপি‘তে বিমার অবদান ৭/৮ শতাংশ। সেসব দেশে বিমা কোম্পানির সংখ্যাও হাতেগোনা। কিন্তু আমাদের এখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণই উল্টো।
বাংলাদেশে বিমার বাজার না থাকলে উদ্যেক্তারা কেন বিমা কোম্পানির লাইসেন্স নিচ্ছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মনসুর বলেন, তারা হয়তা গ্রাহকের টাকা হাতানোর জন্য এই বিষয়ে আগ্রহী। একবার প্রিমিয়াম নিয়ে নিলে সেটি আর ফেরত না দেওয়ার মতো পরিকল্পনা থাকতে পারে। প্রিমিয়াম নেবে, কিন্তু সেটেলমেন্ট করবে না। এ ধরনের কোম্পানি অনুমোদন দেওয়ার কারণেই কিন্তু আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার কেবল রাজনৈতিক কারণে বিমার অনুমোদন দিচ্ছে। কোনো পরিচিত মুখ এসে অনুরোধ করছে, আমাকে মন্ত্রী/এমপি কিছুই করেননি। তখন হয়তো বলা হচ্ছে তুমি একটা কোম্পানি নিয়ে যাও। এভাবে আর্থিক খাত চলতে পারে না।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে আর্থিক খাতের অনিয়মের সবচেয়ে বড় উদারহরণ হলো— বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের রেগুলেটরের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এগুলো বড় ধরনের অশনি সংকেত।
বিমা খাত নিয়ে অর্থনীতিবিদদের এ ধরনের অভিমতের সঙ্গে অবশ্য একমত নন বিমা কোম্পানিগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, নতুন নতুন বিমা কোম্পানি অনুমোদেনের ফলে এই খাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। বেশ কিছু নতুন কোম্পানি ভালো করছে এবং সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
অন্যদিকে বিমা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. শাকিল আখতার বলেন, নতুন নতুন বিমা কোম্পানি অর্থনীতির প্রয়োজনেই দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে বিমা কোম্পানির সংখ্যাও বাড়ছে।
১৩ বছরে ১৯ বিমা কোম্পানির অনুমোদন
বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতা থাকাকালীন কয়েক দফায় ১৯টি নতুন বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের জুলাই ও ডিসেম্বর মাসে দুই দফায় ১৬টি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৬টি কোম্পানির মধ্যে ১৪টি জীবন বিমা ও দুইটি সাধারণ বিমা কোম্পানি। এরপর ২০১৬ সালে একটি এবং বেশ বিরতি দিয়ে চলতি মে মাসে আরও দুইটি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলো হলো— বেস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, তাইয়ো সামিট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, গার্ডিয়ান লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, জেনিথ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, প্রোটেকটিভ লাইফ ইন্সুরেন্স ইনস্যুরেন্স , সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, মার্কেন্টাইল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।
অনুমোদন পাওয়া বিমা কোম্পানির মধ্যে আরও রয়েছে— সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, সেনাকল্যাণ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, আলফা ইসলামী লাইফ, স্বদেশ লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স, যমুনা লাইফ, ভারত বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায় লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অব ইন্ডিয়া (এলআইসি)। সর্বশেষ চলতি বছরে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচল্যান্ড ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স ও এনআরবি ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, দেশে বেসরকারি খাতে প্রথম বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয় আশির দশকে, এরশাদ সরকারের আমলে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় ১৯টি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয় ওই সময়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে ১৯৯৬ সালে ১০টি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০০ সালে রেকর্ড সংখ্যাক ৩০টি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে ১৬টি, ২০১৬ সালে একটি এবং ২০২১ সালে দুইটি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে মোট বিমা কোম্পানির সংখ্যা ৮১। এর মধ্যে ৩৫টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি রয়েছে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর