Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহাসড়কে বাধাহীন দূরপাল্লার বাস

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ মে ২০২১ ২৩:৪৮

ঢাকা: বিধিনিষেধ থাকলেও ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করছে দূরপাল্লার বাস। ঈদের দিন এবং ঈদের পরদিনও মহাসড়কগুলোতে চলতে দেখা গেছে এসব বাস। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লোকাল বাসগুলোও রয়েছে এই তালিকায়। কেবল বাসই নয়, কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকে করেও অবাধে রাজধানী থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ। এসব পরিবহনে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে এসব পরিবহন চললেও কর্তৃপক্ষ বলছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছে, এভাবে যাতায়াত সামনের দিনগুলিতে ঝুঁকি বয়ে আনবেই।

বিজ্ঞাপন

ঈদের দিন শুক্রবার (১৪ মে) ও ঈদের দ্বিতীয় দিন আজ শনিবার (১৫ মে) নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে বাস। তিশা পরিবহন, তাশা পরিবহন, হিমাচল পরিবহন, সৈকত ক্লাসিক, তিস্তা এক্সক্লুসিভ নামে বিভিন্ন বাস সেখানে দাঁড়িয়ে। কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটের যাত্রী তোলা হচ্ছে। সেখান পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কুমিল্লার ভাড়া ২০০ টাকা, ফেনীর ৪০০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

তিশা পরিবহন নামে একটি গাড়ির হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, কুমিল্লায় গেলে ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দূরপাল্লার বাস চলাচলে নিষেধাজ্ঞা চলছে। রাস্তায় বাস আটকে দেবে— এ কথা বলতেই গাড়ির একজন কর্মচারী বললেন, ‘সবাইকে ম্যানেজ করেই তো চালাচ্ছি। আপনার যাওয়ার হলে চলেন। নাইলে এইসব করোনা-ফরোনা বলে টাইম নষ্ট কইরেন না।’

যাত্রাবাড়ী থেকে বাসটি ছেড়ে যাচ্ছিল কুমিল্লার গৌরীপুরের উদ্দেশে

পথের চিত্র দেখতে এই প্রতিবেদক নিজেই গাড়িতে ওঠেন। দেখা যায়, গাড়ির ৫০ শতাংশ নয়, সব আসন পূর্ণ করে নেওয়া হলো যাত্রী। শুধু তাই নয়, চালকের পাশে ইঞ্জিন কাভারেও যাত্রী নেওয়া হলো। কাছাকাছি কোথাও যাবেন— এমন দুয়েকজন দাঁড়িয়েও থাকলেন বাসে। যাত্রীদের প্রায় কারও মুখেই নেই মাস্ক দেখা যায়নি।

গাড়ি সাইনবোর্ড এলাকা পার হয়ে কাঁচপুরে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়ালে দেখা গেল, সেখান থেকেও বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে বাস। আশপাশে পুলিশ থাকলেও তারা কোনো বাসকেই আটকানোর চেষ্টা করছেন না। কাঁচপুর ব্রিজ পার হওয়ার পরও দেখা গেল একই চিত্র। সোনারগাঁও, মদনপুরসহ একটার পর একটা এলাকা পার হলেও বাস আটকানো হয়নি কোথাও। বরং এসব জায়গা থেকেও বাস ছাড়তে দেখা গেছে। কোনো স্টপেজে যাত্রী নামলে সেখান থেকে যাত্রীও তোলা হয়েছে বাসে।

মেঘনা ব্রিজের টোল প্লাজাতেও ছিল পুলিশের উপস্থিতি। তবে বাস আটকানো হয়নি সেখাওনও। দাউদকান্দি পেরিয়ে কুমিল্লাতেও শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে, সম্পূর্ণ বাধাহীনভাবেই পৌঁছে গেল বাসটি।

সাইনবোর্ড থেকে এমন অনেক বাসই ছেড়ে গেছে পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর দিকে

গাড়ির চালকের কাছে জানতে চাইলে বললেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘ম্যানেজ করে’ মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই বাস চলছে। তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় মানুষ তো ঘুরবেই। বাস বের হলে আর কী দোষ? আর রাস্তায় কী হয়, তা সবাই জানে। এই সব করোনা-ফরোনা বলে আসলে কিছু নাই। তাইলে যাত্রী কম নিমু ক্যান?’

প্রায় একই অবস্থা দেখা যায় অন্যান্য বাসেও। আল্লাহ মেহেরবান নামে একটি বাস যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের পথে। যাত্রী পরিপূর্ণ এই বাসের চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনিও জানান, ঈদের দুই দিন আগ থেকেই মহাসড়কে বাস চালাচ্ছেন তারা। সবাইকে ‘ম্যানেজ করে’ গাড়ি চালানোর কারণে এখন আর কেউ বাধা দেয় না।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাস চলাচল করায় তারা খুশিই। কেননা ঈদের এই সময়ে তারা যেকোনোভাবেই হোক, বাড়ি যেতে চান। বিধিনিষেধের প্রথম দিকে বাস চলাচল না করায় মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কারে অনেকে বাড়ি গেছেন, তাদের ভাড়া বেশি লেগেছে বলে তারা শুনেছেন। বাস চলাচল করায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় একটু বেশি হলেও মাইক্রো-প্রাইভেট কারের তুলনায় অনেক কম ভাড়া লাগছে— এতেই তারা খুশি। ফলে করোনা সংক্রমণের ভাবনা তাদের মধ্যে তেমন কাজ করছে না।

কাঁচপুর থেকেও এমন অনেক বাস কুমিল্লা-ফেনীর পথে ছেড়ে গেছে

কুমিল্লা বিশ্বরোড এলাকায়ে গিয়েও দেখা গেল একই চিত্র। সারিবদ্ধভাবে বাস দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রী ডাকা হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের। গাড়ির সব আসনেই নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। বাদ যাচ্ছে না চালকের পাশের জায়গাও। এখানেও পুলিশ নির্বিকার।

এদিকে, বাসের পাশাপাশি প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের অবাধ যাতায়াতও থেমে নেই। শনিবারই সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, জনপথ মোড় ও রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ভৈরবের পথে এমন বহু মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার ছাড়তে দেখা গেছে।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রাইভেট কারে কুমিল্লার ভাড়া ৭০০ টাকা, ফেনীর ভাড়া ১২০০ টাকা করে। অন্যদিকে মাইক্রোবাসের ভাড়া কুমিল্লা পর্যন্ত ৫০০ থেকে ৬০০, ফেনীর ভাড়া এক হাজার টাকা।

প্রতিবেদন যে বাসে চড়েছিলেন, তাতে সব আসনেই যাত্রী নেওয়া হয়েছে

এর বাইরে লোকাল বাস হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোও যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিবহন নামে সায়দাবাদ-গাউছিয়া রুটের এমন একটি বাস কুমিল্লার গৌরীপুর গন্তব্যের যাত্রী তুলছিল।

সায়দাবাদ থেকে শুরু করে কুমিল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীদের সঙ্গে আলাপে উঠে এলো, বাস-মাইক্রোবাস না চললেও তারা বাড়ি যেতেনই, একটু কষ্ট করতে হতো। জেলার মধ্যে বাস চলাচলের অনুমতি থাকায় সেক্ষেত্রে তারা সাইনবোর্ড থেকে যেতেন মেঘনা ব্রিজ পর্যন্ত, সেখানে নেমে হেঁটে পার হতেন মেঘনা ব্রিজ। এরপর সেখান থেকে দাউদকান্দির গাড়িতে চড়তেন। দাউদকান্দি নেমে সেখানেও ব্রিজ হেঁটে পার হবেন। আর টোল প্লাজার পরেই দাঁড়িয়ে থাকে বিভিন্ন গন্তব্যের আরও গাড়ি।

মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস ও অন্যান্য মাধ্যমে যাত্রীদের চলাচল বিষয়ে জানতে চাইলে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করে আর কী লাভ! আমরা তো চেষ্টা করিই বাস আটকে দিতে। অন্য গাড়িগুলোও আমরা আটকে দেই। কিন্তু কয়টা আটকানো যায়, বলেন? যেখান থেকে গাড়ি ছাড়া হয়, সেখান থেকে বন্ধ না করলে রাস্তায় এত গাড়ি কিভাবে আটকাব?

কুমিল্লা বিশ্বরোড এলাকায় দেখা গেছে এমন গাড়ির চাপ। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে এসব গাড়ি

ওসি মনিরুজ্জামান আরও বলেন, এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ কর্তৃপক্ষ কিংবা ঢাকার কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেখান থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা হলে রাস্তায় আর তারা নামতে পারবে না। এখন আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন এভাবে গাড়ি না চলে। কিন্তু এভাবে আসলে ঠেকানো সম্ভব না।

সরকারি বিধিনিষেধের মাঝেও দূরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য যানবাহনে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের ইনস্পেক্টর (টিআই, প্রশাসন) মো. কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এভাবে তো গাড়ি চলতে পারার কথা না। আমরা গাড়ি পেলেই সেগুলোকে আটকে দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আজও অনেক গাড়ি রেকার দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরেও যেহেতু আপনি অভিযোগ করছেন, অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এখনই সেখানে যারা দায়িত্বে আছে, তাদের নির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছি আবারও।

যাত্রাবাড়ী থেকে বিভিন্ন জেলার পথে গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী জোনের উপকমিশনার (ডিসি) সাইদুর রহমান রাজু সারাবাংলাকে বলেন, এভাবে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংক্রমণ যেন না ছড়াতে পারে, সেজন্যই তো এই বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। এখন যদি এভাবে মানুষ যায়, তবে সেই উদ্যোগ কার্যকর হবে না। এমন হওয়ার কথা না। যেহেতু আপনি আমার নলেজে দিলেন, তাই অবশ্যই এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

ডিসি সাইদুর আরও বলেন, যেকোনো আইনই করা হয় রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সব নাগরিককেই সচেতন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের এখানে ব্যতিক্রম ঘটে অনেক ক্ষেত্রেই। দেখা যায় অল্প কিছু মানুষ আইন মানলেও অন্যরা সেটা ভেঙেই চলছে। সেক্ষেত্রে আমরা কঠোর হলেও সেটি গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উঠে আসে। আমরা কড়াকড়ি করতে গেলে সেটাকে বাড়াবাড়ি বলে প্রচার করা হয়। আবার শিথিলতা দেখালে বলা হয় পুলিশের সহায়তায় ঢিলেঢালাভাবে চালানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের জন্য পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। তারপরও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বাস চলাচলের বিষয়টি আমরা আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব।

ছবির দুইটি মাইক্রোবাসই দূরপাল্লার যাত্রী তুলছিল

আশঙ্কায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এভাবে যদি আন্তঃজেলা যান চলাচল করে, তাহলে সংক্রমণ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়ানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়। সংক্রমণ শনাক্তের হার কিছুটা কমতির দিতে আছে। এভাবে চলাচল অব্যাহত থাকলে সেটি অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। বিশেষ করে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে যে অবস্থায় মানুষজন চলাচল করছে বলে শুনছি, তাতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ সম্ভব না। বাসেও যদি অর্ধেক সিট ফাঁকা না রাখা হয়, তাহলে সেখান থেকেও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।

ডা. মুশতাক বলেন, আসলে মানুষকে আগে বোঝাতে হবে যে কেন এভাবে যাতায়াত নিরাপদ নয়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কিভাবে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, এটিও তাদের বোঝাতে হবে। এই বিধিনিষেধ বা লকডাউন যে মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্যই, এটি তাদের বোঝাতে না পারলে তো মুখে আইনের কথা বলে তার বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।

বিধিনিষেধ চলাকালে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়াটা কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, এটি আশঙ্কাজনক বলেই গণপরিবহন বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু যদি এভাবে যাতায়াত চলতে থাকে, সেটি দুর্ভাগ্যজনক। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এসে বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তাই আসলে সবাইকেই সচেতন হতে হবে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

গণপরিবহন দূরপাল্লার বাস মহাসড়কে বাস চলাচল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর