দেশে যেন কোনো মহামারি নেই
১৬ মে ২০২১ ১০:১০
ঢাকা: ‘মরে তো যাবই। করোনার ভয়ে আর কতকাল ঘরে থাকব?’— ঈদের বিকেলে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা নাসরিন বলছিলেন কথাগুলো। জানালেন, ঈদে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাড়ি যেতে পারেননি। সারাদিন ঘরে থেকে এখন এসেছেন একটু বেড়াতে।
নাসরিন ও তার স্বামীর মুখে মাস্ক ছিল না। করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো ভয় কি আর কাজ করছে না— জিজ্ঞাসা করলে নাসরিন বলেন, ‘মানুষ এমনিতেও মারা যাবে, ওমনিতেও মারা যাবে। এক বছরের বেশি হয়ে গেছে। করোনাকে আর কত ভয় পাব?’
তবে করোনা সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরার গুরুত্ব স্বীকার করলেন দু’জনেই। কথা বলতে বলতে ব্যাগ ও পকেট থেকে বের করে পরে ফেললেন মাস্ক।
কেবল নাসরিন নয়, এমন বক্তব্য অনেকেরই। হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন বেড়াতে এসেছিলেন এই মানুষগুলো। তাদের বেশিরভাগের মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি। আর বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে এত মানুষের ভিড়ে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কোনো সুযোগই প্রকৃতপক্ষে ছিল না।
অথচ দেশে এখনো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলছে নানা ধরনের বিধিনিষেধ। মানুষের অবাধ চলাচল ঠেকাতে গণপরিবহন এখনো পুরোদমে চালুর অনুমতি দেওয়া হয়নি। জমায়েত ঠেকাতেও রয়েছে নির্দেশনা। এর মধ্যেই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব ঈদুল ফিতরের আগমন।
এমনিতেই এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষ ঘরবন্দি থাকতে থাকতে বিরক্ত। মাঝখানে পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আসার আগেই ফের সেই বিধিনিষেধের বেড়াজাল। উৎসবের পরিস্থিতি না থাকলেও ঈদুল ফিতরের আগমন হয়তো ঘরবন্দি মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। আর সে কারণেই বাঁধনহারা রাজধানীবাসী, সরকার ঘরে বসে ঈদ উদযাপন করতে বললেও তাদের ঘরে বেঁধে রাখা যায়নি।
ঈদুল ফিতরের দিন শুক্রবার (১৪ মে) ও ঈদের পরদিন শনিবার (১৫ মে) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরোপুরি না হলেও উৎসবের আমেজেই ঈদ উদযাপন করতে বেরিয়েছেন ঢাকাবাসী। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি, কেউ সিএনজি, কেউ মোটরসাইকেল, কেউ রিকশায় চড়েছেন। কারও গন্তব্য সংসদ ভবনের সামনের এলাকা, কারও নভোথিয়েটার, কারও চিড়িয়াখানা, কারও বোটানিক্যাল গার্ডেন, কারও রমনা পার্ক, কারও ধানমন্ডি লেক, কারও বিমান জাদুঘর, কারও হাতিরঝিল। লক্ষ্য একটাই, কিছুটা সময় ঘুরে বেড়ানো। তবে এসব কেন্দ্রের অনেকগুলোই বন্ধ থাকায় অনেকেই কিছুটা হতাশ। তবে হতাশা কাটিয়েই সেই এলাকাতেই বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন তারা।
উত্তরা থেকে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বন্ধ নভ থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন তানিয়া। জানালেন, এর আগে তারা হাতিরঝিলে গিয়েছিল। বললেন, ঈদে তো একটু বের হতেই হয়। তা না হলে ঈদ ঈদ লাগে না। আর ঈদ উদযাপন করতেই সন্তানদের নিয়ে বের হয়ে এতদূর এসেছেন।
জহিরুল ইসলাম যাত্রাবাড়ী থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মোটরসাইকেলে করে রমনা পার্কে ঘুরতে এসে দেখেন বন্ধ। ফলে আরও অনেকের মতো রাস্তার ওপারে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে খোলা জায়গা দেখে সেখানেই বসে যান। মাস্ক পরেননি কেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে পাবলিক প্লেসে লোকজন কম থাকবে ভেবে মাস্ক পরিনি।’ কিন্তু সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ ও মাস্ক পরার গুরুত্ব স্বীকার করে পকেট থেকে মাস্ক বের করে দ্রুত পরে নিলেন তিনিও।
নগরবাসীকে এমন ভিড় করে ঘুরতে দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে। রমনা পার্ক, নভোথিয়েটার, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় ছিল ব্যাপক জনসমাগম। হাতিরঝিলে তো বলতে গেলে বয়ে গেছে জনস্রোত। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাত হচ্ছে, তখনো যেন হাতিরঝিলে মানুষের আগমন বাড়ছেই। রাতের বেলাতেও হাতিরঝিলে রীতিমতো যানজটে নাকাল হতে হয়েছে।
এদিকে গত এপ্রিলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যক্তি মারা গেছেন। তারপরও খুব একটা স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না কারও মধ্যে। এর আগে ঈদের তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হওয়ার আগেই ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। সরকারিভাবে ছুটির সময়ে যার যার কর্মস্থলে থাকার আহ্বান উপেক্ষা করেই দলে দলে রাজধানী ছাড়ে হাজার হাজার মানুষ। দূর পাল্লার বাস, ট্রেন ও ফেরি বন্ধ থাকলেও অঞ্চলভিত্তিক বাস, প্লেন, প্রাইভেট কার, মাইক্রো, ইজি বাইক, পিকআপ, রিকশা, ভ্যান মোটরসাইকেলযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তারা।
ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকেই শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো চিত্র। যেভাবেই হোক, পদ্মাপাড়ি দিতে ব্যতিব্যস্ত মানুষ লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে উঠে পড়েন ফেরিতে। এর মধ্যে ফেরি বন্ধের ঘোষণা থাকলেও মানুষের চাপে শেষ পর্যন্ত ফেরিও ছাড়তে হয়। আবার মহাসড়কে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যমুনা সেতুর দুই পাড়ে যানবাহনের চাপে সেই গণপরিবহনও ছেড়ে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য বছরের মতো না হলেও ঈদযাত্রাই হয়েছে বলা চলে। দেশজুড়ে মানুষের এমন অবাধ চলাচলে করানা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে গেল মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ এতে বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ঈদকে ঘিরে এমন পরিস্থিতি কাম্য ছিল না। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ঢাকায় সবসময়ই বেশি। এখন মানুষজনের অবাধ চলাচলের ফলে গ্রামগুলোতেও করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হলো। আরও এক থেকে দুই সপ্তাহ পর হয়তো আমরা এই উদাসীনতার ফল দেখতে পাব।
মানুষের এই যে নির্বিকার আচরণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি অনীহা— এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে— জানতে চাইলে মনোবিদ হেলাল উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষ নির্বিকার— তা বলব না। আসলে ঝুঁকিবার্তা মানুষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছেনি। প্রথমত, আমরা মানুষের কাছে মহামারির প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। দ্বিতীয়ত, সামাজিক আদব-কায়দা না জানাটাও এর পেছনে একটি কারণ। এই বিষয়টির ঘাটতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেই রয়ে গেছে। মূলত, এই দুই কারণেই আসলে মানুষ এভাবে বের হচ্ছেন বা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, মানুষ দশ নম্বর বিপদ সংকেত বললে ঠিকই বোঝে। সাধারণ মানুষ ঘরে থাকে বা জেলে নৌকা নিয়ে বের হয় না। কিন্তু করোনা সম্পর্কে শুরু থেকেই প্রচারণাটা এমন যে এটি বিদেশি রোগ, বড়লোকের রোগ। একইসঙ্গে সচেতন করতেও আমরা ‘স্টে হোম’, ‘কোয়ারেনটাইন’, ‘সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং’, ‘লকডাউন’ ইত্যাদি বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেছি। নিজেদের ভাষায় নিজেদের সংস্কৃতির উপযোগীভাবে বোঝাতে সক্ষম হইনি দেখেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার বার্তা পৌঁছেনি।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেও ঝুঁকিবার্তা পৌঁছানোর জন্য দু’টি বিষয়ে মনোযোগ দিতে বলা হয়। প্রথমত, যিনি ঝুঁকিবার্তা দেবেন তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে কি না; দ্বিতীয়ত, বার্তাটি সাংস্কৃতিকভাবে সহজবোধ্য হতে হবে। আমাদের দেশে করোনা মহামারির শুরু থেকেই এই দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্যই এখন লকডাউন চললেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর