চীনের ৫ লাখ ভ্যাকসিনে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন যারা
১৭ মে ২০২১ ২৩:১৩
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চীন থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে সিনোফার্মার পাঁচ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। উপহার হিসেবে পাওয়া এই ভ্যাকসিনগুলো সর্বস্তরের জনগণের মাঝে প্রয়োগ না করে প্রয়োজনের ভিত্তিতে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। আর এজন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এবং নার্সিংয়ের শিক্ষার্থীদের প্রয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এছাড়াও পুলিশ বাহিনীর নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরাও পাবেন চীনের সিনোফার্মার ভ্যাকসিন। তবে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে সবাইকে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন সুরক্ষায় নিবন্ধন করতে হবে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন যারা পাবেন
প্রথমে রাজধানীর চারটি মেডিকেল কলেজের এক হাজার শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এরপর ১০ থেকে ১২ দিন অপেক্ষা করে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দেশের মোট ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। একই সঙ্গে সরকারি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ও সরকারি আইএইচটি ও ম্যাটসের সবাইকেও ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের যে তালিকা পাঠানো হবে সেই হিসেবে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র বলছে, মেডিকেল ও নার্সিংয়ের প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার জন ভ্যাকসিন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দুই ডোজ করে ২ লাখ ২০ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীদের পরেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চীন সরকারের অনুরোধে দেশটির যেসব কর্মী বাংলাদেশে আছে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকা চীনের প্রায় ১৫ হাজার কর্মীর জন্য ৩০ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এরপরেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাবেন পুলিশ বাহিনীর যে সদস্যরা ভ্যাকসিনেশন থেকে বাদ পড়েছে তাদের। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ বাহিনীর যে সদস্যরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হননি তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তাদের আনুমানিক ৬০ হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজসহ এক লাখ ২০ হাজার ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
এছাড়াও দেশের পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, রূপপুরসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। এই গ্রুপগুলোতে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে যদি অবশিষ্ট থাকে তখন তা সাধারণ জনগণের মাঝে দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীরা যে কারণে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই হোস্টেলে আসতে পারছে না। তাদের ভ্যাকসিন কার্যক্রমের আওতায় না আনলে মেডিকেল কলেজগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের রোগীর সংস্পর্শে শিক্ষা ও সেবার জন্যে যেতে হয়। একই সঙ্গে নার্সিংয়েও যারা আছেন তাদের নিয়মিতভাবে রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। আইএইচটি ও ম্যাটসে যারা আছে তাদেরও রোগীদের সংস্পর্শে যেতে হয়। তাই আমরা তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা তাদের তালিকা চেয়েছি। তালিকা পাওয়া গেলে সেই অনুযায়ী ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।’
শিক্ষার্থীরা যেভাবে ভ্যাকসিন নেবেন
দেশের ৩৭টি সরকারি ও অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারি নার্সিং, আইএইচটি ও ম্যাটস মিলে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার জন ভ্যাকসিন পাবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তালিকা সরবরাহ করা হবে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। জাতীয় পরিচয় পত্রের ভিত্তিতে তাদের সুরক্ষায় নিবন্ধন করতে হবে। তারপর তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি কারও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকে তবে তারা সেটা পাওয়া পরে নিবন্ধন করতে পারবে। এক্ষেত্রে এনআইডি কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমরা আশা করছি এই ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের সবারই বয়স ১৮ এর উপরে হওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে। তবে যদি কারো না থাকে তাহলে দ্রুতই জাতীয় পরিচয় পত্রের জন্য আবেদন করতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই।’
যেখান থেকে ভ্যাকসিন পাবেন শিক্ষার্থীরা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে ঢাকার চারটি মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন দেবো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে এই এক হাজার ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম এক হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে আমরা ১০ থেকে ১২ দিন অপেক্ষা করব। এই সময় সেই এক হাজার জনকে অবজার্ভ করার পাশাপাশি আমরা সারাদেশে দেওয়ার প্রস্তুতি নেব। এই সময়ের মধ্যে দেশের অন্যান্য স্থানে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে সেখানে লজিস্টিকস সাপোর্ট পাঠানোর প্রস্তুতি নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা নির্দিষ্ট বুথ থেকেই শিক্ষার্থীরা ভ্যাকসিন নেবেন। এক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের ফোকাল পয়েন্ট এবং নার্সিং অধিদফতরের একজনসহ প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হবে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান এই কমিটি করে তারাই তাদের শিক্ষার্থীদের এই ভ্যাকসিন দেবে আমাদের তত্ত্বাবধানে।’
চীনের উপহার হিসেবে দেওয়া ভ্যাকসিন যেখানে রয়েছে
ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ ডোজ সিনোফার্মার ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। ভ্যাকসিনগুলো আমাদের ওয়্যারহাউজে রাখা হয়েছে। এই ভ্যাকসিন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এই ভ্যাকসিনের দুই ডোজের মধ্যে ব্যবধান হলো ২৮ দিন। এক মাসের মধ্যেই আমরা দুই ডোজ দিয়ে দিতে পারব। এই পাঁচ লাখ ডোজের মাঝে আমরা আড়াই লাখ হাতে রেখেই দেবো।
যেদিন থেকে দেওয়া হবে ভ্যাকসিন
সোমবার (১৭ মে) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘চীনের যে ভ্যাকসিন এসেছে সেটির প্রথম ডোজ আগামী ২৫ মে থেকে দেওয়া শুরু হবে। এছাড়া আমরা রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথা বলেছি ভ্যাকসিনের জন্য।’
উল্লেখ্য, ২৯ এপ্রিল নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে চীনে উদ্ভাবিত সিনোফার্মা ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
ওইদিন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমাদের কমিটি এই ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে এক হাজার জনের ওপর প্রয়োগ করে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। আমরা দেখব এই ভ্যাকসিনের সেইফটি এবং অ্যাফিকেসি কেমন। এরপর গণটিকাদান কার্যক্রমে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের ব্যবহার করা হবে।’
সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের এই ভ্যাকসিনের আনুষ্ঠানিক নাম বিবিআইবিপি-সিওরভি (BBIBP-CorV)। এ ভ্যাকসিন ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ করে নিতে হয়। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এ ভ্যাকসিন ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকরিতা দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারীরা।
উল্লেখ্য, গত ১২ মে সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে পাঠায় চীন। দেশে আসার পর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ভ্যাকসিনগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে হস্তান্তর করেন।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম