সিপিবি’তে অস্থিরতা, ঘোষণাপত্র সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন
১৮ মে ২০২১ ১০:০১
ঢাকা: দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, পার্টির কংগ্রেস সামনে রেখে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে। কংগ্রেসে নিজেদের পছন্দমতো নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে পার্টির ঘোষণাপত্রে (গঠনতন্ত্র) সংশোধনী আনার জন্যও কাজ করে যাচ্ছে পার্টির এই অংশটি। এর জন্য জেলা কমিটির নেতাদের নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা চলছে।
পার্টির বিভিন্ন স্তরের একাধিক নেতা বলছেন, এর ফলে ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটিও বিভাজনের মুখে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব সব ধরনের প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে বিভাজ ঠেকানো সম্ভব হবে না। দলের অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় নিয়ে ক্ষোভ জানালেও সিপিবি’র ঢাকা কমিটিসহ জেলা ও শাখা কমিটির নেতারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
পার্টি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অক্টোবরে সিপিবি’র কংগ্রেস হওয়ার কথা ছিল। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থগিত করা হয় সে আয়োজন। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে এ বছরের এপ্রিলে কংগ্রেস আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে পিছিয়েছে সে আয়োজনও। এ অবস্থায় ফের আগামী অক্টোবরে কংগ্রেস আয়োজনের পরিকল্পনা করছে সিপিবি।
কংগ্রেস সামনে রেখেই সিপিবি’র মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাার। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে একটি গ্রুপ। আর সে কারণেই শাখা কমিটিগুলোতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, যদিও নিয়ম রয়েছে— শাখা কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত নিলে কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা অন্য কোনো কমিটি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
কেবল পার্টির শাখা কমিটি নয়, বন্ধুপ্রতিম সংগঠনেও সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের একটি অংশ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র ইউনিয়নে পাল্টপাল্টি সম্মেলন ও কমিটি ঘোষণা নিয়ে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা গেছে, তার পেছনেও সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির ওই অংশটির প্রভাব রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপে ছাত্র ইউনিয়নের দুইটি পক্ষকে সমঝোতায় এনে কমিটি করে দেওয়া হয়। সেখানেও অবশ্য প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় থাকা সিপিবি কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশটির পছন্দের নেতৃত্বকে জায়গা দিতে হয়েছে কমিটির ওপরের দিকে।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ৪ বছর আগে ঢাকা কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভাজের সূত্রপাত। নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করেন, যোগ্য নেতারা ওই কমিটিতে পদ পাননি। কেন্দ্রীয় সদস্য অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন ওই সময় প্রকাশ্যে কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান। এ নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়। ওই সময়ই দুই গ্রুপের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। বেশকিছু কর্মসূচিতে বাগবিতণ্ডা থেকে শুরু করে রীতিমতো হাতাহির ঘটনাও ঘটে।
সিপিবি’র আরেকটি অংশ মনে করছে, ঘোষণাপত্র সংশোধনের মাধ্যমে দলের বর্তমান নেতৃত্বই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। কিন্তু ঘোষণাপত্র সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। সে কারণেই কংগ্রেসের ভোটারদের নিজেদের পক্ষে রাখতেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে।
জেলা কমিটি এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো ব্যক্তি না থাকলেও তার সেই শূন্যতা কোনো না কোনোভাবে পূরণ হয়ে যায়। যদি দলের শীর্ষ নেতাদের কাউকে নেতৃত্বে বহাল রাখতে ঘোষণাপত্রে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়, আমরা তার বিরোধিতা করব। এমন প্রয়াস যারা চালাচ্ছে, বুঝতে হবে তারা নতুন নেতৃত্ব, সঠিক নেতৃত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরে জেলা কমিটির একজন নেতা বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতেই পার্টির অনেকের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা রয়েছে— অস্বীকার করার উপায় নেই। নানা ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটানোর চেষ্টা চলছে, যার চর্চা এর আগে কখনো সিপিবি’তে দেখা যায়নি। তারপরও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা চলছে।
দলের নেতৃত্ব ও প্রভাব বিস্তারের প্রসঙ্গই নয়, দলের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়েও এখন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দল হলেও দলের কিছু নেতা আওয়ামী লীগের এবং কিছু নেতা বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ার প্রভাব জেলা-উপজেলা কমিটিতেও পড়ছে। কেন্দ্রীয় একজন নেতার ভাষ্য, এরকম প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আদর্শচ্যুত হয়ে পড়বে সিপিবি।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম দলের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কথা স্বীকার করে নিলেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, সিপিবি মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট ও বিশৃঙ্খলা আছে। তবে এসব আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই এরকম সংকট থাকে। তবে আমরা সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে। এরপর এই বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আগামী কংগ্রেসে শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বা পক্ষই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— এই দুই ধারায় বিভক্ত। সিপিবিই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সমাজতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনীতি করে। আশা করি পার্টির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মিটিয়ে সামনের কংগ্রেসে আমরা ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হব।
পুরনো নেতৃত্বকে বহাল রাখার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোষণাপত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— এমন অভিযোগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শাহ আলম বলেন, ঘোষণাপত্রের সংশোধনীর বিষয়টি ঠিক করবে কংগ্রেস। কংগ্রেসে কাউন্সিরলররা চাইলে ঘোষণাপত্র সংশোধন হবে, না চাইলে হবে না। আর আগামী নেতৃত্বও ঠিক হবে গোপন ভোটের মাধ্যমে। ফলে প্রভাব বলয়ের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটির খুব একটা ভিত্তি নেই।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর