করোনাতেও বাড়ল মাথাপিছু আয়, অর্থনীতিবিদরা বলছেন অস্বাভাবিক
১৮ মে ২০২১ ২২:২১
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের এই সংকটকালেও সরকারি হিসাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬৩ মার্কিন ডলার করে। সরকারের এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও করোনা সংকটের এই সময়ে দেশের আমদানি-রফতানি ও বিনিয়োগ কমে গেছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে তারা বলছেন, দেশের মানুষের আয় গত একবছরে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। একইসঙ্গে বেড়েছে বেকারত্বের হার, দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। এ পরিস্থিতি আগের বছরের তুলনায় মাথাপিছু আয় ১৬৩ ডলার বা ৯ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার হিসাবকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন তারা।
এর আগে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে গতকাল সোমবার (১৭ মে) মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরে জানান, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু এই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।
একই বৈঠকে আগের অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়ে যাওয়ার তথ্যও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। আগের অর্থবছরে যেখানে মোট জিডিপি ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে একবছরে জিডিপি বেড়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লে মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে। তবে করোনা সংকটের মধ্যেও সরকারি হিসাবের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, বলা হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৬ শতাংশের মতো। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম হওয়ায় মাথাপিছু আয় কিছুটা বাড়ার কথা। কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে, তা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। কারণ বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে এসব নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, চলতি অর্থবছরে কেবল রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও রফতানি খাতের অবস্থা সুবিধাজনক না। বিনিয়োগের পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কাজেই সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথাপিছু আয় কিভাবে এতটা বেড়েছে, এটিও একটি প্রশ্ন।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, সিভিল সোসাইটিসহ সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়েছে, করোনাকালে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এ অবস্থায় কিভাবে মাথাপিছু আয় ১৬৩ ডলার বাড়ে? সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে এই পরিসংখ্যানের কোনো মিল নেই।
তিনি বলেন, যদি আয় বেড়েই থাকে তাহলে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষের হাতে এই আয় চলে গেছে। আবার এই সম্ভাবনাও কম। কারণ করোনায় কোনো খাতেই বড় ধরনের আয় বাড়েনি। গত এক বছরে পোশাক শিল্প মালিক, কলকারখানার মালিকরাও খুব বেশি লাভ করতে পারেননি। এই সময়ে ফার্মাসিউটিক্যালস ও গ্রোসারি খাতে কিছু লাভ হলেও অন্য সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হওয়াটা অস্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে এবং এই হিসাবটি প্রশ্নবিদ্ধ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক তুলে ধরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাকালে সানেমসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে দেখানো হযেছে, মানুষের আয় কমে গেছে। একটি বড় জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও ধাক্কা খেয়েছে। তারপরও যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েই থাকে, তাহলে মাথাপিছু আয় স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। মাথাপিছু আয় তখনই কমবে যখন প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে। তবে আমাদের প্রবৃদ্ধি নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি বলেন, করোনাকালে বিভিন্ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাহিদা ও জোগানের সংকটও রয়েছে। মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে, নতুন কর্মসংস্থান নেই। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া এবং মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ বেড়ে যাওয়া নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিকল্প কোনো তথ্য আমাদের কাছে না থাকায় আমরা নিজেরাও কোনো হিসাব করতে পারছি না। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়।
সেলিম রায়হান বলেন, প্রবৃদ্ধি কত হলো কিংবা মাথাপিছু আয় বাড়ল নাকি কমলো, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ করোনাকালে আর্থিক ও কাজের সংকটে পড়া মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবনা। অনেকে কাজ হারিয়েছে। অনেকের কাজ থাকলেও আয় কমে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত ৫০ বছরেও এমন সংকট দেখা যায়নি। এই সংকট মোকাবিলা করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না এবং পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না— সেদিকে নজর দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এরকম সংকটকালে কিভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লো, কাদের আয় বাড়লো— এই প্রশ্নও উঠতে পারে। তাই আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক আলোচনা না করে বরং কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য— এই দুইটি দিকে নজর দিতে হবে। প্রবৃদ্ধির ধূম্রজালের চোরাবালিতে আমরা যেন আটকে না থাকি, সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
করোনা সংকট করোনা সংক্রমণ করোনাভাইরাস জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাথাপিছু আয়