মুক্তিহরণ সরকার : আত্মজয়ী ‘বৃহন্নলা’
২২ মে ২০২১ ১৯:৫২
আমি তো অজ্ঞাতবাসে এসেছি,
আমি তো অজ্ঞাতবাসে এসেছিলাম।
এই যে আমি হাসছি, খেলছি, বেড়াচ্ছি
তোমাদের সাথে গল্প করছি
এ আমি তো প্রকৃত আমি নই।
…
এমনি অজ্ঞাতবাসেই আমি বৃহন্নলা হয়ে
উত্তরাকে নৃত্যগীতি শিখিয়েছিলাম।
সংযুক্তার স্বয়ংবর সভায় পৃথ্বিরাজ হয়ে
আমিই কি অজ্ঞাতবাসে থাকিনি?
অর্জুনের মতো ‘বৃহন্নলা’ হয়ে অজ্ঞাতবাসে আসা মুক্তিহরণ সরকারের এই আত্মমূল্যায়নের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর জীবন ও কর্ম অধ্যয়ন-বিশ্লেষণের পরতে পরতে।
তাঁর অজ্ঞাতবাসের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট। গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় আট মাইল উত্তরে সাদুল্যাপুর থানার কামারপাড়া ইউনিয়নের ধনকুঠি গ্রামে। বাবা নীলমাধব সরকার (১৮৯২-১৯৬৫) ও মা সরযূবালা সরকার (কুমুদিনী) [১৯২৫-১৯৮৭]। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে মুক্তিহরণ সরকার ছিলেন ষষ্ঠ। পিতা নীলমাধব সরকারের পেশা ছিল শিক্ষকতা। যতটা-না শিক্ষক তারও চেয়ে বেশি পণ্ডিত অভিধায় অভিষিক্ত ছিলেন তিনি স্বীয়গুণে। বলা যায়, এই পুরুষানুক্রমিক পাণ্ডিতেরই উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন মুক্তিহরণ সরকার।
বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর পিতার কাছেই। পণ্ডিত পিতার তত্ত্বাবধানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষার অনেকটা পথ পাড়ি দেন। এরপর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় একবারে তৃতীয় শ্রেণি থেকে, বাড়ির পাশে লক্ষ্মীপুর হাইস্কুলে। এ বিদ্যালয় থেকেই এসএসসি (১৯৬৪) পাস করে ভর্তি হন গাইবান্ধা সরকারি কলেজে। এখান থেকে ১৯৬৯ সালে ও ১৯৭২ সালে যথাক্রমে এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি নেন ১৯৮০ সালে। এর বাইরে ঠাকুরগাঁও পিটিআই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন (সিইনএড) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। আর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে লাভ করেন বি.এড (উচ্চতর) ও এম.এড ডিগ্রি।
এত বিশাল বিদ্যার ভাণ্ডার বুকে নিয়ে সামসময়িককালের বিবেচনায় মুক্তিহরণ সরকারের বেকার থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তাই-ই হয়েছিল। বিএড প্রশিক্ষণ শেষে স্থানীয় বামনডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ডাক আসে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হয়তো-বা শিক্ষকতার পেশায় পা বাড়ান তিনি। কিন্তু স্কুলের অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক কদর্য-কোন্দল ও স্বার্থদ্বন্দ্বে অল্পদিনেই ওই চাকরির প্রতি অনীহা আসে তাঁর। এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর আক্ষরিক অর্থে চাকরি বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে আর সম্পৃক্ত ছিলেন না।
গত শতাব্দীর নয়-এর দশকের শেষের দিকে তাঁর সমমনা কতিপয় সহযাত্রীকে নিয়ে নেমে পড়েন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে। এই উদ্যোগেও নিজের আর্থিক দৈন্য ঘোচানোর বিষয়টি ছিল একেবারেই গৌণ। অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত সমাজের একটি বিরাট অংশে আলোকশিখা প্রজ্বালনের উদ্দেশ্যই ছিল মুখ্য। মনে পড়ে, এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটিও তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর অনুজপ্রতিম অনুসারীদের অনুরোধেই।
বিদ্যালয় গড়ে তোলা, একান্তই দায়বদ্ধতা থেকে লেখালেখি করা, সর্বোপরি তাঁর চারপাশের গণমানুষের বিপদ-আপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন মুক্তিহরণ সরকার। কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘সবই শূন্য থেকে’। সে কথাও তিনি তাঁর এক সুহৃদ-সতীর্থকে লিখেছেন এভাবে
কয়েকদিন আগে থেকেই চিঠি লিখবো ভেবে ছিলাম। কিন্তু হাতে পয়সা একেবারেই ছিলো না, বেশ কয়েকদিন স্কুলে গিয়েছি শুধু জল খেয়ে… যা টিফিন হয় তাই… বিকেল চারটার দিকে এসে ভাত খাওয়া। এভাবেই স্কুল গড়ে তুলছি। দেশ উদ্ধার করছি।
যে বিদ্যালয় গড়ে তুলতে গিয়ে পুরো দশটি বছর নিজের মেধা, মনন ও শ্রমকে কাজে লাগিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয় থেকে তিনি একটি কানাকড়িও পাননি পারিশ্রমিক হিসেবে। কারণ দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা, জাতিকে শিক্ষিত করার ঢাকঢোল পেটানোর এই যুগেও সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্তাবাবুদের ‘খুশি’ করতে না পারায় তাঁর রক্তে-ঘামে-শ্রমে গড়ে তোলা বিদ্যালয়টি স্বীকৃতি পেলেও শিক্ষকদের জন্য কোনো অর্থ-সাহায্য কিংবা সরকারি অনুদান পায়নি তাঁর মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত। অথচ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা চলেছে ঠিকমতোই। তাঁর প্রিয় ছাত্রীরাও পাস করে বেরিয়েছে কৃতিত্বের সঙ্গে।
বিদ্যালয় গড়ে তোলা, শিক্ষকতাসহ সমাজের অন্যান্য কল্যাণকর্মে নিবেদিত থাকার পাশাপাশি মুক্তিহরণ সরকার সাহিত্যসাধনা ও সাংবাদিকতার মহান দায়িত্ব ও পালন করেছেন উল্লেখযোগ্য নিষ্ঠা-নৈপুণ্যে। স্থানীয় ও জাতীয় অনেক পত্রপত্রিকায় নিরীক্ষাধর্মী সংবাদ-ফিচার লিখেছেন নিয়মিত।
মফস্বল থেকে আমৃত্যু সাংবাদিকতা করেছেন মুক্তিহরণ সরকার। মফস্বল সাংবাদিকদের অবর্ণনীয় দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ে মালিক-প্রকাশকদের প্রতি ক্ষোভ ঝরেছে তার কলমে। কাজ করে পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল লেখার মূল লক্ষ্য। তার ভাষায়
আমি এটিকে অর্থনীতির নিরীখে বিচার করতে চাই। যেহেতু এটি শ্রম সুতরাং তার পারিশ্রমিক থাকবে। আমার লেখা বিক্রি করে মালিক পয়সা উপার্জন করবেন আর লেখক-সাংবাদিককে ‘পয়সা’ দেবেন না তা হয় না। বরং পত্রিকা মালিকের পত্রিকা সংক্রান্ত সমুদয় সম্পত্তিতে লেখক-সাংবাদিকরা যেকোনোভাবে যুক্ত, সবাই অংশীদারও বটে।
[সাংবাদিকতা করতে পারি, দিনমজুরি দেবেন তো?; মুক্তিহরণ সরকার রচনাসমগ্র, পৃ. ১৮১-১৮২,]
মফস্বলের সাংবাদিকদের দৈন্য তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে তাদের অধপতনের চিত্রও তুলে ধরেছেন নিসংকোচে।
অনেক পীড়াপীড়িতে সাংবাদিকদের ‘পরিচিতিপত্র’ দেওয়া হয় – নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। কর্তৃপক্ষ ভাবেন, এই ‘পরিচিতিপত্র’ (আইডেনটিটি কার্ড) দিয়ে সংবাদদাতা ‘করে খেতে’ পারবেন। সুতরাং তাঁকে (সংবাদদাতাকে) আর টাকা-পয়সা দেওয়ার কি থাকতে পারে? বাধ্য হয়ে অনেক সাংবাদিক যে সেটিকে কাজে লাগান না – তা নয়। বরং পেট নামক যে একটি বস্তু আছে তাকে ভুলে গেলে অনেক বড়ো বাস্তবতাকেই ভুলে যেতে হয়। সাধু-সন্ন্যাসীদেরও লোকালয়ে আসতে হয় – দুমুঠো খাবারের জন্যেই। অথচ সাংবাদিকদের (রাজধানীর বাইরের) সামান্য টাকার সংস্থান করলে, সাংবাদিকরা তাঁদের আদর্শ বজায় রেখে কর্তব্য কর্ম অত্যন্ত সততার সাথে পালন করতে পারতেন। তা না করে তাঁদেরকে অন্যায় পথে নিয়ে যেতেই বাধ্য করা হচ্ছে। এরপরও যাঁরা আদর্শ বজায় রেখে কাজ করছেন (শত মানসিক নির্যাতনের মধ্যেও) আমার মনে হয় তাঁদের জন্ম বাংলাদেশ স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে হয়েছে জন্যই সম্ভব। স্বাধীনতা-উত্তর নতুন প্রজন্মের ছেলেদের কাছে এ মানসিক দৃঢ়তার উদাহরণ বেশি একটা দেখিনি। (ব্যতিক্রম যে থাকবেন না – তা নয়)।… আমার মনে হয়, একটি পত্রিকা বের করতে গেলে সম্ভাব্য ব্যয়ের দিকটি যখন খতিয়ে দেখা হয়, তখন অফিসের পিন, পেপারওয়েটের কথা ভাবা হলেও বাইরের সাংবাদিকদের যে পারিশ্রমিক দিতে হবে সেটি বিন্দুমাত্র ভাবনাতে আসে না। কারণ, সংবাদপত্র জগতে মফস্বল সাংবাদিকরাও হচ্ছেন সবচেয়ে সহজ সস্তা (প্রাকৃতিক সম্পদের মতো) যা পেতে পয়সা লাগে না। [প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১-১৮২,]
আজ যখন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, নিরপেক্ষতা তিরোহিতপ্রায়; উল্টো লেজুড়বৃত্তি, লালসা, অসততায় নিমজ্জিত সেখানে মুক্তিহরণ সরকারের প্রতিটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অন্যায়ের চিত্র, প্রতিবাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠ হয়ে কথা বলেছে তার প্রতিবেদনগুলো। তাঁর সাংবাদিকতায় ছিল কৃষক-শ্রমিকসহ গণমানুষের স্বার্থরক্ষার অকুণ্ঠ প্রচেষ্টা। কৃষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সব সময়ই সোচ্চার ছিল মুক্তিহরণ সরকারের লেখনী। তিনি কৃষককে আখ্যায়িত করেছেন প্রকৃত কৃষিবিজ্ঞানী ও মাঠের কবি হিসেবে। তাদের সম্মানিত করেছেন ‘নিরক্ষর ডক্টরেট’ অভিধায়। কবি আর কৃষকের মধ্যে কোনো ব্যবধান খুঁজে পাননি।
কথাটি শুনে হঠাৎ খটকা লাগলেও আসলে আমাদের দেশের নিরক্ষর কৃষকরাই ভালো কৃষিবিজ্ঞানী। কথাটির প্রমাণ মিলবে অবারিত মাঠ-গগন-ললাট চুমে যার পদধূলি সেই গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে। এ দেশের কৃষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। তাই দেখা গেছে, ইরির জমিতে তারা দেশি সার যেমন গোবর, পচা আবর্জনা প্রভৃতি প্রয়োগ করেও দিব্যি ভালো ফসল উৎপাদন করেছেন, রাসায়নিক সার ছাড়া যা কৃষিবিদগণ কখনো চিন্তাও করেননি। সাথী ফসলের আবাদও তারা যদিও কোনো বই-এ পড়েননি কিংবা বই-এ আদৌ উল্লেখ নেই এমন সাথী ফসলও নিজের বুদ্ধিবলে ফলিয়েছেন বা ফলাচ্ছেন – যেমনটি গ্রাম পর্যায়ের কৃষি মাঠকর্মীরাও ভাবতে পারেননি। … কৃষক জমিতে পা রেখেই বলতে পারেন মাটির গুণাগুণ। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির প্রাণিকুল, গাছপালা, ফসলের নীরব ভাষা তো আর কারো বুঝবার কথা নয় – বুঝবার কথা তাদের যাদের সাথে শস্য চারার আছে আজন্ম সাহচর্য, প্রতিদিনের কথা বলা। আর এদের মর্মবাণী বুঝতে না পারলে তো বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। সেদিক দিয়েও কৃষকরাই প্রকৃত কৃষিবিজ্ঞানী। [নিরক্ষর ডক্টরেট, দৈনিক দেশ, ঢাকা]
পরিবেশ সাংবাদিকতায়ও মুক্তিহরণ সরকারের সুগভীর চিন্তন ও প্রসারিত চৈতন্যের মূর্ত প্রকাশ দেখতে পাই আমরা- যা সর্বৈব স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।
পলিথিনের ব্যবহার এখন মানুষের জগত ছেড়ে পাখির জগত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। গৃহস্থবাড়ি ঘেঁষা পাখিরা যেমন শালিক, গোবরে শালিক ডিম পাড়ার সময় বাসায় পলিথিন নিয়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক দৃশ্য।… যদিও কোনো দোকান থেকে পাখিরা এগুলো কিনে নেয় না (অর্থনীতির জ্ঞান ওদের এখনো আসেনি) তবু পাউরুটির প্যাকেট, ব্যাগের টুকরো কিংবা বিভিন্ন ধরনের পলিথিনের টুকরো (পড়ে থাকা অথবা কাঁদায় আটকে থাকা) এরা বেশ যতেœর সাথেই সংগ্রহ করে এবং এর উপর ডিম পাড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলে মনে হয়। অবশ্য পলিথিন তৈরি ঘর বানানোর কারিগরি জ্ঞানও একদিন পাখিরা অর্জন করবে কি না বলা যায় না। [পাখিরাও পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছে, পূর্বাভাস, ঢাকা]
একইভাবে তার ‘শেয়ালের সংখ্যা বেড়েছে : বাবুই পাখির নতুন আস্তানা’, ‘প্রকৃতির বাঁশিওয়ালা ঝিঁঝিঁ পোকা’; ‘শামুক নিয়ে কথা’ [দৈনিক দেশ, ঢাকা]; ‘একজন গাছপ্রিয় মানুষ হেদায়েতুল্লাহ’ [সাপ্তাহিক একতা, ঢাকা] প্রভৃতি প্রতিবেদন মুক্তিহরণ সরকারের পরিবেশ ভাবনার উজ্জ্বল উদাহরণ।
আর সাহিত্যসৃজন, সে তো বলা যায় কৈশোর থেকেই। শুরু করেছিলেন সেই ছয়-এর দশকে, অব্যাহত ছিল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তিনি আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত মুক্তিহরণ সরকার রচনাসমগ্র-এর সূচনাখ-ের ভূমিকায় তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে ওই গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক আখতার হুসেন লিখেছেন: রিপোর্টাজ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ভাষ্য, গ্রন্থ সমালোচনা, সতীর্থদের কাছে লেখা চিঠির (বলা বাহুল্য, এখানে মাত্র অল্প কিছু চিঠি প্রকাশ করা হলো) পাশাপাশি মুক্তির মৌলিক রচনার পরিমাণও একেবারে গৌণ নয়। জীবিতাবস্থায় গরিবানা হালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিলো মাত্র দুটি বই। প্রথমটি গল্প সঙ্কলন। নাম ‘জনা কয়েকের গল্প’। গাইবান্ধা থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো এটি। অন্যটি বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক। নাম ‘বাংলা ব্যাকরণের কয়েকটি বিষয়’ (সময়াভাবে বইটি বর্তমান গ্রন্থে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী খণ্ডে তা প্রকাশে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ)। এটিও প্রকাশিত হয় গাইবান্ধা থেকেই। অথচ ওর প্রাথমিক পরিচিতি শিশু-সাহিত্যিক হিসেবে। ওর রচিত নানা মেজাজের, নানা রসের, নানা বিষয়ের ছড়া ও কবিতার সংখ্যাই বেশি। সেসবে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম নেই। ঈর্ষণীয় দক্ষতারছাপ প্রায় অধিকাংশ ছড়ার গঠন-শৈলীতে, বিষয় নির্বাচনে, অন্ত্যমিল ও ছন্দের প্রকরণে। অথচ যেসসব ছড়া-কবিতা সঙ্কলিত করে যেখানে তার জীবনের প্রথম বই প্রকাশিত হতে পারতো, হওয়া উচিতও ছিলো, তা না হয়ে প্রকাশিত হয় ছোটগল্পের বই, যা তার সাহিত্যিক-পরিচিতিকে তেমন দ্যুতিময় করতে সাহায্য করে না। তবু দু-তিনটি গল্প থেকে থেকেই চমকে দেয়। মনে হয়, ও আরো যত্নশীল কেনো হলো না ছোটগল্প রচনায়? বিশাল খেদে ওকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইচ্ছে করে বারবার।
আর্থিক দৈন্যই আজীবন অকৃতদার রেখেছিল মু্ক্তিহরণ সরকারকে। কোনো এক নির্জন মুহূর্তে সাহসভরে এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম একদিন। তখন নিঃসঙ্কোচে অথচ বিনম্র ভঙ্গিতে আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, এমন কপর্দকশূন্য অবস্থায় এ-পথে কি আমার পা বাড়ানো উচিত? কিন্তু মায়ের অন্তিম ইচ্ছাই আপন ইচ্ছা হয়ে অবলীলায় প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর লেখাতেই: ‘…মায়ের অন্তিম ইচ্ছে ছিলো যেনো সংসারী হই, তাই মন থেকে এখনো দূর করতে পারিনি বিষয়টা।’ (ছোটবোনকে লেখা চিঠির খসড়া/প্রেম, গাইবান্ধা)
মুক্তিহরণ সরকারের কল্যাণমূলক কর্মগুলোই প্রমাণ করে ‘বৃহন্নলা’রূপে বিরাটনগরে আসা অর্জুনের অজ্ঞাতবাসের সমার্থক ছিল তার ইহলৌকিক জীবন। যিনি কেবল মানুষের উপকার করেছেন; আর দৃঢ়ভাবে অথচ বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন সমস্ত প্রলোভন- যেভাবে রাজকুমারী উত্তরাকে পেয়েও নিতে চাননি অর্জুন।
প্রসঙ্গত, মহাভারতে বর্ণিত পঞ্চপা-বের তৃতীয় অর্জুনের আরেক পরিচয় ‘বৃহন্নলা’। ইন্দ্রের রাজসভার অপ্সরা উর্বশীর প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার অভিশাপে বৃহন্নলা রূপ পরিগ্রহ করেন তিনি। এরূপে অজ্ঞাতবাসের ত্রয়োদশ বছরে বিরাট রাজার মৎস্য রাজ্যে অবস্থানকালে রাজকুমারী উত্তরাকে নাচ ও গান শিখিয়েছিলেন। এ সময় অর্জুনের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে আশ্চর্য হন রাজা বিরাট। তিনি স্বীয় কন্যা উত্তরাকে বিয়ে করতে অর্জুনকে অনুরোধ জানান। কিন্তু অর্জুন উত্তরার শিক্ষক ছিলেন, তাই তিনি রাজার অনুরোধ উপেক্ষা করেন। পৌরাণিক কাহিনিমতে, বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার এলাকায় ছিল রাজা বিরাটের মৎস্য রাজ্যের রাজধানী।
১৯৮৬ সালে মাতৃবিয়োগ ঘটে মুক্তিহরণ সরকারের। মাতৃমৃত্যু-পরবর্তী দৈনন্দিন জীবনযাপনের চরম অনিয়ম, আর্থিক দৈন্য- এসব কিছুই তাঁর স্বাস্থ্যহানি ঘটায় দ্রুত। দেহে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি। বেলাশেষের বাঁশিটি বাজে তাঁর মর্মমূলে। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাওয়া অন্য দশজন মানুষের মতোই বাঁচার আকুতি তীব্র হয় মুক্তিহরণ সরকারের মধ্যে। গভীর আত্মবিশ্বাস আর বাঁচার তীব্র বাসনা নিয়ে ১৯৯৭ সালের ১১ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নেহধন্য রণজিৎ কুমার সরকারকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার্থে চলে আসেন ঢাকায়। স্থানীয় চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে ব্যাগে করে নিয়ে আসেন নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান লাভের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সিল, প্যাড। সুস্থ হয়ে স্কুলের কাজ সেরে তাঁর সহকর্মীদের জন্য একটা শুভ সংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন- এটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা।
মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের এই সুন্দর-সমাজভাবনা, কল্যাণব্রতচারিতা দেখে আমরা বিষ্মিত হই। পত্রিকার মাধ্যমে অসুস্থতার খবর পেয়ে রাজধানীতে বসবাসকারী শুভাকাক্সক্ষীরা সচেষ্ট হন তাঁর যথাযথ চিকিৎসার ব্যাপারে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং সাহাবুদ্দিন আহমেদও। কিন্তু এক সময় সমস্ত প্রচেষ্টাই পরাভব মানে স্রষ্টার অমোঘ নিয়মের কাছে। ১৯৯৭ সালের ২২ মে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে নিজের অভিহিত ‘অজ্ঞাতবাস’ থেকে ছুটি নেন মুকতিহরণ সরকার। আজ তাঁর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী অপার শ্রদ্ধা আত্মজয়ী ‘বৃহন্নলা’র জন্য।
সাইফুল ইসলাম: লেখক ও সাংবাদিক