আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার: শুধুই কি ব্যয় সংকোচন?
২২ মে ২০২১ ২৩:২৯
আল কায়েদা-ওসামা বিন লাদেন-তালেবান-আফগান। এই শব্দগুলোর সঙ্গে এশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষই পরিচিত। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধের যুদ্ধের নামে আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর ধরে আসন গেঁড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলার পর এর জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করা হয়। আর সেই আল-কায়েদাকে মদত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আফগানিস্তানের তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূল অভিযান শেষ হলেও দীর্ঘদিন ধরে তালেবান নিধনের নামে মার্কিন সেনারা সেখানে অবস্থান করছিল। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু তাদের হঠাৎ সিদ্ধান্ত বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব মোড়ল রাষ্ট্র এই বিষয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিশ্ব রাজনীতির রথী-মহারথীরা মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারকে ঘিরে রাজনীতির বিভিন্ন ধরনের জটিল হিসাব কষছেন। এমনকি এই সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে খোদ মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র মতভেদ। বিভক্ত হয়ে পড়ছে মার্কিন বুদ্ধিজীবী সমাজ। কেন বিশ্ব রাজনীতিতে এই বিভক্তি? কেন বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে এই মতভেদ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আলোকপাত করতে হবে মার্কিন–আফগান সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে।
১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলসহ দেশের অন্যান্য অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সেই সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা বিদ্রোহ করে বসে। ওই সময় ওসামা বিন লাদেনের মতো কিছু আরব নাগরিক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। আর ওই মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এতে ধীরে ধীরে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখানে বলে নেওয়া ভালো, আফগান মুজাহিদদের আমেরিকার সাহায্যের অন্যতম কারণ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীতি। এই সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতেই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে তালেবান বাহিনী গড়ে তোলে আমেরিকা। এক সময় তালেবানরা আমেরিকার প্রতক্ষ্য সহায়তায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে সক্ষম হয়। এমনকি এই আমেরিকা কাঁধে নিয়ে উৎক্ষেপণযোগ্য বিমান ধ্বংস করার মতো স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য আফগান মুজাহিদদের সরবরাহ করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই আমেরিকার মদতে গড়া বাহিনী আমেরিকার রিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়াতে যে তালেবানি শক্তির উত্থান আমেরিকা ঘটিয়েছিল সেই শক্তিই এক সময়ে আমেরিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা চালায় আল-কায়েদা। আর আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে মদত দেয় আফগান তালেবানরা। সেই হামলার পর ওই বছরই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিনবাহিনী। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে চালানো অভিযান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ইতিহাসে দেশের বাইরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধ।
এই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, তালেবানরা আমেরিকার মদতে শক্তিমান হয়ে উঠে পরবর্তী সময়ে তারা সেই আমেরিকার বিরুদ্ধেই যুদ্ধে ব্যবহার করে। আমেরিকার ইতিহাসে মোট চারজন প্রেসিডেন্ট তালেবান শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে। তারা হলেন- জুনিয়র বুশ, বারাক ওবামা, ট্রাম্প এবং জো বাইডেন। তবে ট্রাম্পের আমল থেকে মার্কিনীরা এই যুদ্ধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকে। এই যুদ্ধের ব্যয় মার্কিন সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। যে তালেবানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আফগান আক্রমণ করেছিল মার্কিনবাহিনী, সেই তালেবানদের সঙ্গে কাতারের দোহায় শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় তারা। ট্রাম্পের পর জো বাইডেন এসে নতুন সরকার গঠনের পর পরই মার্কিন সরকার সৈন্য প্রত্যাহারের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়।
দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা তালেবান-আমেরিকান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকেও চড়া মুল্য দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব মতে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে অন্তত এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানে নিজেদের সেনা পাঠানোর বদলে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে ব্যয় বেশ কমে আসে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে তাদের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব থেকে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাব মতে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন প্রশাসনের সামরিক ব্যয় হয়েছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও ৪৪ বিলিয়ন ডলার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে। সব মিলিয়ে ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করলেও সেখানকার ব্যয় ধরা হয়নি এই হিসাবে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা ‘কস্ট অব ওয়্যার’ প্রোজেক্ট নামে এক গবেষণায় দাবি করা হয়, আফগান যুদ্ধে ব্যয়ের যে সরকারি হিসাব দেখানো হয়েছে তা প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছিল।
এত চড়া মূল্য পরিশোধ করেও মার্কিনবাহিনী খুব একটা সুবিধা তো করতেই পারিনি বরং কিছু ক্ষেত্রে নাস্তানাবুদ হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক প্রকাশিত এক মার্কিন গোপন নথিতে দেখা যায়, মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, আফগান যুদ্ধে তাদের কৌশলগত ভুল ছিল এবং আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে গিয়ে তাদের বহু অর্থের অপচয় ঘটেছে। আফগানে মার্কিনবাহিনী সুবিধা করতে না পারার অন্যতম কারণ ছিল তালেবান জঙ্গিদের ‘এট্রিশন’ পদ্ধতি প্রয়োগ। সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন কলাকৌশল ও পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হলো ‘এট্রিশন’। যার প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে- ক্রমাগত প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, হতে পারে সেই আক্রমণটি ছোট পরিসরে। তবুও সেটি চালিয়ে যাওয়া। এই ক্রমাগত আক্রমণের ফলে প্রতিপক্ষের আর্থিক অবস্থা চাপের মুখে পরে এবং সৈনিকদেরও মনোবল ভেঙে যায়। এই কৌশল অবলম্বনের কারণে সামরিক ও অর্থনৈতিক, উভয়ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনী তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। ফলে মার্কিন সরকার বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হয়।
তবে মার্কিন সরকারের এই রহস্যময় পিছুটানের কারণে নিঃসন্দেহে আফগানিস্তান আরেকটি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। মার্কিন সরকার অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন দুই বিপরীতমুখী দলকে এমন অবস্থায় রেখে যাচ্ছে যেখান থেকে আসলে তাদের সহাবস্থান অনেকাংশেই অসম্ভব। জেনেশুনে মার্কিনিরা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং এই কাজটিও তারা করেছে বেশ পরিকল্পনা মাফিক। এই পরিকল্পনার সূত্র ধরে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক অস্পষ্ট এবং অবাস্তব চুক্তি করে। যে চুক্তিতে ইচ্ছে করেই অনেক বিষয় অস্পষ্ট এবং উহ্য রাখা হয়। যেমন- মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে, বিশেষ করে চুক্তি অনুসারে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হলে, তখন কাবুলের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার পরিধি কেমন হবে সেই বিষয়ে স্পষ্টভাবে চুক্তিতে কিছু বলা নেই। বরং এই চুক্তিতে কিছুটা ছাড় পেয়েছে তালেবান জঙ্গিরা। কারণ শর্তানুযায়ী চুক্তি সম্পাদনের পর আফগান সরকারকে পাঁচ হাজার তালেবান জঙ্গিকে মুক্তি দিতে হবে।
বর্তমান আফগান সরকার বিশ্বাস করে গণতন্ত্রে। অপরদিকে তালেবান বিশ্বাস করে শরিয়া আইনে। নারী নেতৃত্ব ও নারী শিক্ষা নিয়ে আফগান সরকার ও তালেবানদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতা এবং দুই বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক বা সমঝোতা কীভাবে হবে তার রূপরেখা চুক্তিতে না থাকার ফলে এর আদৌ কোনো মূল্য থাকছে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে! তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মার্কিনবাহিনীর রহস্যময় প্রস্থানের ফলে আফগানিস্তান আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। তবে মার্কিনিদের এই পিছুটান কি শুধুই যুদ্ধের ব্যয় সংকুলান করতে না পারা? না কি আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেশটাকে জঙ্গিবাদের চারণভূমি বানিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্যবাদের নতুন পরিকল্পনার অংশ?— তা সময়-ই বলে দেবে।
লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/পিটিএম