পরামর্শক কমিটি গঠন করলেও তাদের পরামর্শই সরকার মানেনি
২৩ মে ২০২১ ১৩:২৭
মো. শাহ আলম। বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে ন্যাপ–কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। চট্টগ্রামে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীতেও ছিলেন দীর্ঘ দিন। ২০১৭ সালের মে মাসে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ অসুস্থতাজনিত কারণে দায়িত্ব থেকে অব্যাহত নেন। ওই সময় সিপিবি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন শাহ আলম। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি, সমসাময়িক রাজনীতি ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল। দু’জনের কথোপথনের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
সারাবাংলা: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শাহ আলম: এককথায় বললে সরকার দক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। এই বৈশ্বিক মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রথম থেকেই ইদুর-বিড়াল খেলা খেলছে। সরকার তার অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল। শুরু থেকেই একটি মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করে সে অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার বিচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনসচেতনতা বাড়িয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলে অনেক বেশি সুফল পাওয়া যেত। সরকার নিজ দলসহ বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারত। তা না করে সরকার গুটিকয়েক লোকের ওপর নির্ভর করেছে, সরকার আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। এমনকি জাতীয় যে পরামর্শক কমিটি সরকারই গঠন করেছে, তাদের পরামর্শই সরকার মানেনি। অনেকেই বলছেন, নামমাত্র পরামর্শক কমিটি। অথচ পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা উচিত ছিল সরকারের। তা না করে পরামর্শক কমিটিকে পাশ কাটিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সারাবাংলা: সরকার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের বিধিনিষেধ চালু করেছে। কিন্তু সেই বিধিনিষেধ সেভাবে মানতে দেখা যায়নি জনগণকে।
শাহ আলম: যেভাবে সরকারের কাজ করার কথা ছিল, সেভাবে সরকার করতে পারেনি। ভারতে যেমন রেশনিং পদ্ধতি চালু আছে। বাংলাদেশ রেশনিং পদ্ধতি চালু করলে সরকারের দেওয়া লকডাউন অনেক কার্যকর হতো। সরকার মন্দির-মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মশালা মাস্ক সরবরাহ করতে পারত। জনগণকে সচেতন করে তুলতে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কাজে লাগাতে পারত। সরকার এসব কিছুই করেনি। তা না করে লকডাউন দিয়েছে। আবার গাড়ি বন্ধ করে অফিস চালু রেখেছে। গোটা বিষয়টিই ছিল ধোঁয়াশাপূর্ণ। জনগণকেও জীবিকার তাগিদে বের হতেই হয়েছে। জনগণের জন্য আধুনিক পদ্ধতি চালু করা উচিত ছিল।
সারাবাংলা: অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও করোনাকালে খুব একটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখবেন?
শাহ আলম: দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির কোনো ভূমিকাই নেই এই করোনা মোকাবিলায়। তারা আছে টেলিভিশনসহ অন্যান্য মিডিয়ায়। আর সংসদের কথিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, তাদেরও একটি বড় ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তারা জনগণের পাশে নেই। তারা আছে কেবল বিবৃতি মধ্যে। কিন্তু মহামারিতে দলমত নির্বিশেষে সবার একসঙ্গে এগিয়ে এসে কাজ করা উচিত ছিল। সেটি এখানে হয়নি।
সারাবাংলা: গত কয়েকমাসে হেফাজতে ইসলাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সরকার এখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
শাহ আলম: এক কথায় এই সংগঠনের রাজনীতিসহ সরকার তাদের যে একাডেমিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, তা বাতিল করা উচিত। এই হেফাজত টিকে থাকলে এবং তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে ঘরে ঘরে গোলাম আযমের সৃষ্টি হবে। তখন তা মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। এই হেফাজত ইসলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেছিল। মূলত এরা নিজাম ইসলামে সংগঠনের লোগো-নাম পাল্টিয়ে হেফাজত হয়েছে। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, পাওয়ার পলিটিক্স করতে গিয়ে হেফাজত ইসলামের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার স্বাধীনতার পক্ষের সরকার। সরকার হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করতে গিয়ে যে কাজটি করেছে, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। হেফাজত ইসলাম জাতির জন্য আত্মঘাতী। এদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
সারাবাংলা: সাম্প্রতিক সময়ে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাম মোর্চাসহ কমিউনিস্ট ভাবধারার দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বাম দলগুলোর জোটবদ্ধ রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেছ কি?
শাহ আলম: সিপিবি তার নীতি-আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুতি হয়নি, হবেও না। আবার আমাদের ওপর ভর করে কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় যাক— সেটিও আমরা হতে দেবো না, তাতে আমাদের যত কষ্ট হোক হবে। তবে আমরা বাম গণতান্ত্রিক জোট নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ২০ দলীয় জোট ও মহাজোটের বাইরে গিয়ে বিকল্প একটি ধারা তৈরি করতে চাচ্ছি। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘেঁষা রাজনৈতিক দলগুলোকে রাখা হবে না। এটি দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরের একটি রাজনৈতিক শক্তি হবে। এখন সবকিছু লুটেরা পুঁজিবাদী তাদের দখলে। এই লুটেরা পুঁজিবাদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে গণতন্ত্র হারিয়ে গেছে। রাজনীতি এখন লুটেরা পুঁজিবাদীদের হাতে জিম্মি। সেই জিম্মি দশা থেকে রাজনীতিকে মানুষের মাঝে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সারাবাংলা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই কি এই জোট নিয়ে পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন?
শাহ আলম: নির্বাচনে আমরা কম-বেশি অংশগ্রহণ করছি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওপর আমাদের আস্থা নেই। কমিশনকে সবদিক থেকে স্বাধীন হতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। তাদের ওপর ভূতর আছর আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে, তারা যেন স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ তার পরের বিষয়।
সারাবাংলা: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহ আলম: সারাবাংলাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মো. শাহ আলম সাধারণ সম্পাদক সিপিবি