জমির নেশায় আউয়ালের ‘ইশারায়’ পল্লবীতে ৭ খুন!
২৩ মে ২০২১ ২৩:১৯
ঢাকা: এম এ আউয়াল। ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান, তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক সংসদ সদস্য। ২০১৪ সালে তরিকত ফেডারেশনের হয়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। শুধু তাই নয়, এমপি তকমা কাজে লাগিয়ে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় শীর্ষ দখলদার বনে যান তিনি। আর এই দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করতে এ পর্যন্ত তার ইশারায় সাতজন খুন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, আউয়াল নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে যে আলীনগর আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছেন তার পুরোটাই দখল করা জমির ওপর। আর এ জন্য সরকারি, বেসরকারি ও মানুষের নিষ্কণ্টক জমি সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখল করেছেন। কেউ জমি দখলে বাধা দিলে সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারধর করেতেন, এমনকি একের পর এক মামলা দিয়ে নাজেহাল করতেন জমির মালিকদের। সেটিতে কাজ না হলে জমির মালিককে হত্যার পথ বেছে নিতেন সাবেক এমপি আউয়াল। ওই এলাকায় তার এতটাই দাপট যে, মোস্তফা নামের অবসরপ্রাপ্ত এক মেজরের জায়গাও দখল করেছেন তিনি। ওই মেজর পল্লবী থানায় একটি মামলাও করেছেন।
গত ১৬ মে পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে জমির মালিক সাহিনুদ্দিনকে সাত বছরের শিশুছেলের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উম্মোচন করে। গ্রেফতার করা হয় সাবেক এমপি আউয়ালসহ ৭/৮ জনকে। র্যাব জানায়, এমপি আউয়ালের পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়। ঘটনার আগে আউয়ালের কলাবাগান অফিসেই খুনের পরিকল্পনা করা হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেয় সন্ত্রাসী সুমন, মানিক, মনির, হাসানসহ ১০/১২ জন।
রোববার (২৩ মে) পল্লবীতে গেলে স্থানীয় লোকজন এই হত্যাকাণ্ডের নানাবিধ বর্ণনা দেন। স্থানীয়রা জানান, এই জমি নিয়ে খুনের মতো ঘটনা ঘটবে তা সবাই আঁচ করতে পেরেছিলেন। পুলিশও অনেকটা আঁচ করেছিল যে, কিছু একটা ঘটবে। কেননা এর দুমাস আগেও সাহিনুদ্দিনকে এই সন্ত্রাসীরাই মাথায় এলোপাতাড়ি কুপিয়েছিল। ওই সময় তার মাথায় ২১টি সেলাই পড়ে। আবার হাসপাতাল থেকে না ফিরতেই সাহিনুদ্দিনের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা ঠুকে দেয় আউয়াল ও তার লোকজন। সেই মামলায় ঈদের এক সপ্তাহ আগে জামিনে বের হন সাহিনুদ্দিন। আর ঈদের একদিন পরই তাকে হত্যা করা হয়।
সরেজমিনে জানা যায়, মিরপুর-১২ এর বুড়িরটেক, টেকেরবাড়ি ও বাউনিয়া মৌজায় অধিগ্রহণ করা জমিতে স্বপ্ননগর নামে একটি আবাসিক প্রকল্প তৈরি করছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্পের পাশেই সাবেক এমপি আউয়াল ক্ষমতার জোরে জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন আলীনগর আবাসিক প্রকল্প। তার কোম্পানির নাম হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ। এই প্রকল্পের প্রতি ইঞ্চি মাটি দখল করা। আর সেই জমি দখল করতে ওই এলাকায় গত কয়েক বছরে ঝরেছে অন্তত সাতটি প্রাণ। যার সবশেষ বলি সাহিনুদ্দিন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রথমে জমি কেনার প্রস্তাব দিতেন সাবেক এমপি আউয়াল। প্রস্তাবে সাড়া না দিলে হামলা, তারপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। তাতেও কাজ না হলে খুন করতেও দ্বিধা করতেন না। এসব অপকর্মের জন্য আউয়াল নিয়ন্ত্রণ করতেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এসব বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। পুলিশও সবসময় আউয়ালের পক্ষ নিয়েই কথা বলতেন।
সাহিনুদ্দিনের পরিবার জানিয়েছে, পল্লবীর বাসিন্দা জয়নুদ্দিনের দুই ছেলে সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিন। পারিবারিকভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ১২ একর জমি। সেই জমির দখল পেতে আউয়ালের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সাহিনুদ্দিনের পরিবারের।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় মমিন বক্স ছিলেন মিরপুর এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। রাজধানীর পল্লবীর ৯ নম্বর ও ১২ নম্বরে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যূতার অভিযোগে তার নামে ছিল ১৮ মামলা। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় মমিন বক্সকে। এর চার দিন পর কালশী ব্রিজ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।
২০১৫ সালের ১৪ মে বুড়িরটেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বঙ্গবন্ধু কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী চঞ্চল খুন হন। ওই হত্যা মামলায় মমিন বক্স ছিলেন প্রধান আসামি। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে মমিন বক্স ও চঞ্চল খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আমান। আমানের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণসহ ১৪টি মামলা আছে। মমিন বক্সের পর খুন হন মাছ ব্যবসায়ী পাগলা খোকন ও ডি-ব্লকের স্থানীয় মিন্টু। এরপর কালাপানির মুসা, ডিওএইচএস সড়কে খুন হন পাকিস্তানি মোহাম্মদ আলী।
২০০৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিরামিকের পেছনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কথিত র্যাব-পুলিশের সোর্স আব্বাসকে। আব্বাস হত্যার পর আলোচনায় আসেন সাবেক এমপি আউয়াল। ওই সময় হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ গড়ে বুড়িরটেকে শুরু করেন দখলবাজি। স্থানীয়দের দাবি, সবগুলো হত্যার পেছনে সাবেক এমপি আউয়াল জড়িত রয়েছে।
গত ১৬ মে পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিনকে। হত্যার পর একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ঘটনায় র্যাব-পুলিশ ৭/৮ জনকে গ্রেফতার করে। পরে র্যাব জানায়, ভিডিওতে যে দুজনকে কোপাতে দেখা গেছে তারা হলো- মনির ও মানিক। এর বাইরেও সুমন, হাসানসহ ১০/১২ জন কিলিং মিশনে অংশ নেয়। কিলিং মিশন সফল করতে আউয়াল তাদের নিয়ে কলাবাগানের অফিসে পরিকল্পনা করেন। ইতোমধ্যে মানিক র্যাব ও মনির গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, সাবেক এমপি আউয়াল প্রায়ই তার ক্যাডার বাহিনীকে বলতেন, ‘হয় জমি ছেড়ে দেবে না হলে তাদের লাশ পড়বে। কখনও কখনও ফোনে বলতেন, যত টাকা লাগে লাগুক, তবুও লাশ চাই, লাশ!’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র্যাব এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তদন্ত শুরু করে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাবেক এমপি আউয়ালসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। পরবর্তী সময়ে অভিযান চলাকালীন আসামি মানিক বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। তবে অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম
৭ খুন এম এ আউয়াল জমি দখল পল্লবী সাবেক এমপি হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ