Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অনলাইনে প্রতারণা, ক্রেতা-বিক্রেতার সুরক্ষায় আসছে নীতিমালা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ মে ২০২১ ১০:১৬

ঢাকা: ভারতের সেরা ব্র্যান্ডের শাড়ি, পাকিস্তানের থ্রিপিস, থাইল্যান্ডের জুতা, ব্যাগ, ফ্রান্সের পারফিউম, সরাসরি দুবাই, আমেরিকা থেকে আনা কসমেটিকস্ তাও অর্ধেক দামে। এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে তারা। তবে শর্ত একটাই এ সকল পণ্য সংগ্রহ করতে হবে কুরিয়ার থেকে। আর কুরিয়ার চার্জ হিসাবে দুইশো টাকা পাঠাতে হবে বিকাশ কিংবা নগদে। সস্তায় ভালো মানের সেরা ব্র্যান্ডের পণ্যের এমন বিজ্ঞাপন দেখে সাতপাঁচ না ভেবেই অর্ডার করেন ক্রেতারা। কিন্তু হাতে পাওয়া প্যাকেট খুলে দেখেন পুরোটাই প্রতারণা।

প্রতারণার শিকার রাজধানীর সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের শিক্ষিকা তানজিনা আক্তার জানান মাস খানেক আগে ইন্ডিয়ান শাড়িজ নামের একটি ফেইসবুক পেইজ থেকে সাউথ ইন্ডিয়ান কাতান অর্ডার করেছিলেন। দোকানে যে শাড়ির দাম পাঁচ হাজার টাকা দেখেছিলেন সেই একই রকম শাড়ি ফেসবুকের ওই পেজে মাত্র ১৮০০ টাকা দেখে অর্ডার করেছিলেন। দেশের একটি জনপ্রিয় ও নামি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাকে শাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু কুরিয়ারে মোট সাড়ে ১৯০০ টাকা পরিশোধ করে যে শাড়ি হাতে পেয়েছেন তা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ইন্ডিয়ান কাতানের বদলে আমাকে পাঠিয়েছে লোকাল হাফসিল্ক শাড়ি। যার দাম ৫ থেকে ৬শ টাকা। আমি কল্পনা করতে পারিনি যে, এমন বড় ধরনের প্রতারণা তারা করবে। পরে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সে ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

সুরভী আক্তার। পেশায় গৃহিনী। গত সপ্তাহে ডিসকাউন্ট শপ নামের একটি পেইজ থেকে ওয়াল সেলফ কিছু রান্না ঘরের জিনিসপত্র অর্ডার করেছিলেন। তিনি জানান, যদিও হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে তাকে। ঘরে এনে প্যাকেট খুলে দেখেন সবগুলোই আগে ব্যবহার করা, ময়লা জিনিসপত্র। কোনোটার গায়ের বার্নিশও উঠে গেছে। ওই পেইজে এ বিষয় জানানো হলে উল্টা গালিগালাজ করে তাকে ব্লক করে দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেইসবুকে ভূয়া ই- কমার্স পাতা খুলে বিভিন্ন দেশের সেরা ব্র্যান্ডের ছেলে মেয়েদের পোশাক, ঘড়ি, জুতা, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদ পাতে। তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন থেকে কেউ যখন অর্ডার কনর্ফাম করে তখন একটা বুকিং মানি নেয়। এরপর নকল, ভাঙাচোরা, নষ্ট ও নিম্নমানের ব্যবহারের অনুপোযোগী পণ্য চাকচিক্যময় প্যাকিং করে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেয়।

অনলাইনে কেনাবেচা সহজ করতে বেশ কিছু উদ্যোক্তারা গ্রুপ খুলেছেন ফেসবুকে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে উই, হার ই ট্রেড, রিসাইকেল বিন, হাইফাইভসহ বিভাগীয় পর্যায়ে ব্যবসায়ীদেরও বেশ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। সেখানে বিক্রেতা, ক্রেতা উভয়ই পণ্য দেখতে পারেন কেনাবেচাও করে থাকেন। সে সব পেজে প্রতারণার শিকার হয়ে ক্রেতারা তাদের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করে থাকেন। সেখান থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রতারণা করে এমন পাতার মধ্যে সাডোরা, স্মার্ট ডিল বিডি, ডিসকাউন্ট শপ, স্টাইল ডোর-৭, দারাজ-৭১, ফ্যাশন জোন, বিডি ৭১, সোনিয়া ফ্যাশন হাউজ, শপিং ডেলস, চায়না ফ্যাশন বিডি, ইন্ডিয়ান শাড়ী কালেকশন, অরিজিনাল কুর্তি কালেকশন।

সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকমাস আগে প্রতারকদের তিনটি চক্র মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। তখন জানানো হয়েছিলো, এরা ফেইসবুকে বিভিন্ন ভুয়া পেজ খুলে ওয়েবসাইট থেকে বিশ্বের সেরা ব্রান্ডগুলোর ছবি ডাউনলোড করার পর আপলোড করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদ পাতে। এভাবে প্রতারণা করে ২০২০ সালে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ই- কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই- ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদিও ই- কমার্স বিসনেজ বাংলাদেশ শুরু হয় এক দশক আগে। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা বাড়ে গত দুই থেকে তিন বছর আগে থেকে। গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে অনলাইনে কেনাকাটার প্রয়োজনীয়তা যেমন বাড়ে আবার ব্যবসাও বৃদ্ধি পায়। আমরা ই- কমার্সটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। আমরা সব সময়ই বলি যখন অনলাইনে কেনাকাটা করবেন, তখন অবশ্যই পেজটি ভেরিভাইড কিনা দেখে কিনবেন। ই- ক্যাবের সদস্য কোনো পেইজ যদি প্রতারণা করে তাহলে ক্রেতারা অভিযোগ করলে সেখানে আমরা ওই পেজকে তথ্য প্রমাণ নিয়ে শোকজ করতে পারি। কিন্তু সদস্যের বাইরে ভুয়া পেইজ তৈরি করে কেউ প্রতারণা করলে সেখানে সহযোাগিতা করার সুযোগ ই-ক্যাবের কম থাকে।’

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর দেশের ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতি কাটাতে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু যে সব ব্যবসায়ী অনলাইনে কেনাবেচা শুরু করেছিলেন তাদের জন্য করোনাকালীন সময়টা পৌষ মাস বলা যায়। গত বছর অনলাইন ব্যবসায় তুমুল গতি আসে। গত এক বছরে অনলাইনে এই ব্যবসা বেড়েছে কয়েকগুণ। লেনদেনও বেড়েছে বহুগুণে।

জানা যায়, বর্তমানে ওয়েবসাইট ভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২০০০। এছাড়াও ফেইসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক ৫০ হাজার উদ্যোক্তা রয়েছে। ই- কমার্সের এই উত্থানের পাশাপাশি এ খাতে বাড়ছে প্রতারণাও।

সূত্রে জানা গেছে, ই- কমার্সে ক্রেতা কোনো কারণে প্রতারিত হলে তার অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। তবে সেখানে অভিযোগের নিষ্পত্তিতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। এ সমস্যা সমাধানে ই-কমার্সের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা ই- সাপোর্ট সেন্টার রয়েছে। সেখানে ভোক্তাদের অভিযোগ পর্যালোচনা করে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে থাকে। আবার চলছে নীতিমালা তৈরির কাজ।

জানা যায়, বাংলাদেশে ই- কমার্সের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। গত কয়েক বছরে এর পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ই- কমার্সকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে একটি নীতিমালা তৈরি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যা চূড়ান্তের পথে। সেখানে পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া মূল্য জরিমানাসহ ফেরত দেওয়া, খারাপ, মানহীন পণ্য সরবরাহকে ফৌজদারি আওতায় প্রতারণা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ই- কমার্স নীতিমালা ২০২১ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এখন সে খসড়ায় সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। মতামত নেওয়া শেষ হলে এটি চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। বিদ্যমান অসঙ্গতি হ্রাসের পাশাপাশি গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকার ই- কমার্স খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্যই এই নীতিমালা প্রণয়ন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন জানান, খসড়া নীতিমালায় এ খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়ার পর চূড়ান্ত করে এর প্রয়োগ শুরু হবে। এই নীতিমালা হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে। ই-কমার্স খাত শৃঙ্খল থাকবে।

সারাবাংলা/জেআর/একে

অনলাইনে প্রতারণা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর