বেড়িবাঁধ ভাঙার আতঙ্কে খুলনা উপকূলের মানুষ
২৬ মে ২০২১ ১১:৫২
খুলনা: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও ভরা পূর্ণিমায় খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে জোয়ারে পানি স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের পানির তোড়ে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। স্থানীয়রা ঝুকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করলেও তা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার পশুর, চুনকুঁড়ি, ঢাকি, শিবসা, কাজিবাছা, ঝপঝপিয়া ও মাঙ্গা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে আড়াইফুট থেকে ৩ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, পানখালী ইউনিয়নের ঝপঝপিয়া নদীর পানখালী ফেরিঘাটের পূর্বপাশে প্রায় ১০ ফুট বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একই নদীর ফেরিঘাটের পশ্চিমপাশে জাবেরের খেয়াঘাট সংলগ্ন ২০০ ফুট বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কাজিবাছা নদীর খলিসা স্লুইস গেট সংলগ্ন প্রায় ২০০ ফুট, চালনা পৌরসভার চুনকুঁড়ি নদীর আবুলের স’মিল সংলগ্ন বেড়িবাঁধের প্রায় ১৫০ ফুট ও একই নদীর কামিনীবাসিয়া গাইন বাড়ি সংলগ্ন প্রায় ৩০০ ফুট বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। শিবসা নদীর ঝালবুনিয়া খেয়াঘাটের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে প্রায় ৩৫০ ফুটের মত বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মঙ্গা নদীর কামারাবাদ খেয়াঘাট সংলগ্ন প্রায় ১০০ ফুট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া ছুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি ও শিবসা নদীর মোহনার কালাবগী গ্রামের ঝুলন্তপাড়ার প্রায় ৪০০ পরিবার জোয়ারের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
কালাবগী গ্রামের ঝুলন্তপাড়ার সালাম মোল্লা ও রবিউল ইসলাম জানান, বর্তমানে তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রণজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রায় ১৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, রাত-দিন চেষ্টা করে বেড়িবাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে।
কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও ভরা পূর্ণিমায় কয়রার নদ-নদীতে মঙ্গলবার রাতের জোয়ারে প্রায় ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতের জোয়ারে কপোতাক্ষ নদের গোবরা গুচ্ছ গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে। গ্রামবাসী তাৎক্ষণিক মাটি দিয়ে বাঁধ রক্ষা করে। বর্তমানে ওই গ্রামের প্রায় ৫ হাজার মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। একই নদের পদ্মপুকুরে ১ হাজার ফুট বেড়িবাঁধ ও হরিহরপুর গাজীপাড়ায় আধা কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ উপচে কাটকাটা বাজারের পূর্বপাশে আধা কিলোমিটার পাউবোর বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এছাড়া শাকবাড়িয়া নদীর আংটিহারা বেড়িবাঁধের প্রায় ১ হাজার ফুট, জোড়সিং গ্রামের পূর্বপাশে প্রায় আধা কিলোমিটার ও গাতিরগ্রামে প্রায় ১ হাজার ফুট বেড়িবাঁধ বর্তমানে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
অপরদিকে, কয়রা সদর ইউনিয়নের হামকুড়া খালের পূর্বপাশে আধা কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামের আধা কিলোমিটার এলাকা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নদীর জোয়ারের পানির তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকা যেকোনো সময় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ ও ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীতে পানির স্বাভাবিক মাত্রা থাকে ৩ মিটারের কাছাকাছি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস এবং পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে আরও দুই ফুট বেশি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত বেড়িবাঁধগুলো ৪ মিটার পানির উচ্চতা ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। তবে কোথাও কোথাও বাঁধের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তা অনেক নিচু অবস্থায় রয়েছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তবে পানির প্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তা ফেলে পানি আটকানোর চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, আগামী দুই দিনে পানির উচ্চতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হলে পানি আটকানো সম্ভব হবে না।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। তবে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখানো হলে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হবে।
খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, বুধবার সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কি.মি.পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড় খুলনায় ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫-২০ কি.মি. দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনায় ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজ বুধ ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। তবে, বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে বৃষ্টিপাত কমতে পারে বলে তিনি জানান।
সারাবাংলা/এএম