মানুষের লোভে বিপন্ন টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য
২৮ মে ২০২১ ০৯:১৪
সুনামগঞ্জ: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন হলো জলাভূমিগুলো। দেশের উত্তর-পূর্বপ্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলার জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠাপানির টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলিতে মুখর টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি ও অন্যান্য জলজ প্রাণির এক বিশাল অভয়াশ্রম। তবে মানুষের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর লোভের বলি হচ্ছে এই হাওর ও এর জীববৈচিত্র্য।
টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা ও ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে ইজারা প্রথা বিলুপ্ত করে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকেন। সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
তবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির লোক এখনও চুরি করে মাছ ও পাখি শিকার এবং বনজঙ্গল কেটে উজাড় করছে। প্রশাসনের হাতে মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে জীববৈচিত্র্য বিপন্নকারী এসব ব্যক্তি। এমনকি হাওরে রাতের বেলায় টর্চ জ্বালিয়ে পাখি শিকার করারও অভিযোগ আছে।
জ্বালানি হিসেবে অবাধে কেটে নেওয়া হচ্ছে নলখাগড়া, চাইল্যাবন, হিজল-করচ গাছের ডালপালা। এতে উজাড় হচ্ছে ঘন সবুজ বন। নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের কারণে হাওরের নিচের জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে ওপার থেকে নেমে আসা বালুর কারণে ভরাট হচ্ছে হাওর ও তৎসংলগ্ন নদী।
এছাড়া হাওরে পর্যটকদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের থালা, পলিথিন, চিপস-চানাচুরের প্যাকেট এবং সংরক্ষিত এলাকায় উচ্চশব্দে মাইক বাজানোয় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। হাওর পার্শ্ববর্তী হোটেলে খাবারের বিশেষ আইটেম হিসেবে দেখানো হয় অতিথি পাখির মাংস। এতে বিপন্ন হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য।
নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর। টাঙ্গুয়ার হাওর প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ। এই হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারি। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি এই হাওরকে করেছে মোহনীয়। এছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমুলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদিসহ দুইশ প্রজাতিরও বেশি গাছগাছালি রয়েছে এই প্রতিবেশ অঞ্চলে।
শীত মৌসুমে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখর হয় টাঙ্গুয়ার হাওর। বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংস্টর্ক, শকুন এবং বিপুলসংখ্যক অতিথি পাখি ছিল টাঙ্গুয়ার হাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর।
গত ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরে মোট ৩৯ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে, যার মধ্যে ২৭টি পরিযায়ী প্রজাতির। এবারের শুমারিতে পৃথিবীজুড়ে মহাবিপন্ন প্রজাতির পাখি বেয়ারের ভুতিহাঁস দেখা গেছে। বিরল প্রজাতির বৈকাল তিলিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, কুঁড়া ইগল, খয়রা কাস্তেচরা, উত্তুরে টিটি ও কালো লেজ জোড়ালি পাখিও দেখা গেছে।
জাতীয় পাখি শুমারির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরে এক লাখ ৪৬ হাজার পরিযায়ী পাখি দেখা গিয়েছিল। সে বছর দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ পরিযায়ী পাখি এসেছিল। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের যৌথ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের গবেষণায় বলা হয়, দেশের হাওর এলাকায় সার প্রয়োগ কম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সেখানে আসা পরিযায়ী পাখিদের বিষ্ঠা প্রাকৃতিক সার হিসেবে ভূমিকা রাখে। ফলে হাওরে ধান ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও এসব পাখি ভূমিকা রাখছে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরকে আন্তর্জাতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে যেসব আনসার সদস্য পাহারা দেওয়ার কাজ করছেন, তাদের বেতন বকেয়া ছিল দীর্ঘদিনের। ঈদের আগে তাদের সবার বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে, ওখানে পাখি, মাছ বা গাছগাছালি কেটে নেওয়ার সংবাদ পাওয়া গেলে আনসারদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’
এছাড়া পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে সেখানে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের চিন্তা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সারাবাংলা/এমও