Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হতাশা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের, পরিবার-সমাজকে পাশে থাকার তাগিদ

নিফাত সুলতানা মৃধা, তিতুমীর কলেজ করেসপন্ডেন্ট
২৮ মে ২০২১ ২০:১৫

প্রায় দেড় বছর হলো গোটা বিশ্ব নাকাল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে। গত বছরের মার্চ থেকে একই পরিস্থিতি বাংলাদেশেও। ওই মাস থেকেই বন্ধ দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গত বছরের শেষের দিক থেকে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে কিছুটা আশার আলো দেখা দেয়। সরকারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবার সব পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কোনো তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না কেউই।

বিজ্ঞাপন

একবছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব ব্যাপকভাবেই পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাসসহ দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও প্রযুক্তিগতসহ নানা সমস্যার কারণে সেগুলো কার্যকর হয়নি। তাতে শ্রেণিকক্ষ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থীরা, পড়ালেখার সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ঘরবন্দি থাকায় প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার বেড়েছে তাদের মধ্যে। তার সুফলের পাশাপাশি কুফলের দৃষ্টান্তও দেখা যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অলস সময় কাটাতে হওয়ায় উচ্চ শিক্ষা তথা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন নানামুখী চাপের মুখে। বিশেষ করে যারা শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে ছিলেন, তারা সেশন জটসহ কর্মজীবনে প্রবেশ করার অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয়— এমন পরিবারের শিক্ষার্থীদের পারিবারিক চাপও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সামাজিকভাবেও অনেককে সহ্য করতে হচ্ছে গঞ্জনা, লাঞ্ছনা। অনেককে এই করোনাকালে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। কিন্তু সেটিও তারা নির্বিঘ্নে করতে পারছেন না।

সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির একবছর পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থাতেও যদি নীতি নির্ধারকরা শিক্ষার্থীদের জন্য সুষ্ঠু দিকনির্দেশনামূলক কোনো ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে না পারেন, সেটি হতাশাজনক। কেননা পরিবার-সমাজের পক্ষ থেকেই বর্তমান অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের মানসিক সমর্থন পাচ্ছে না। শিক্ষা গবেষণায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের যেমন মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত হওয়ার চর্চা গড়ে তুলতে হবে; তেমনি পরিবার ও সমাজকেও বাস্তবতা উপলব্ধি করে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী রুবায়না রশিদ রিপা জানালেন, ক্যাম্পাস খোলা থাকা অবস্থায় নিজের খরচ চালাতে টিউশনি করতেন। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে একসময় টিউশনি ছাড়তে হয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় নিজের খরচ চালানোর চাপ ছিল। যে কারণে খণ্ডকালীন একটি চাকরি করছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ হতাশ তিনি।

রুবায়না রশিদ রিপা সারাবাংলাকে বলেন, করোনা সবকিছু বদলে দিয়েছে। পড়ালেখায় ছন্দপতন হয়েছে। কলেজ আজ খুলবে, কাল খুলবে— এমন করতে করতে কলেজ খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় আর্থিক সমস্যা ছিল। শেষ পর্যন্ত একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে ঢুকেছি। নিজের খরচ মিটিয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, যদিও এটি পর্যাপ্ত নয়। জানি না এ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে।

রুবায়নার প্রত্যাশা— দেশে সবকিছুই কমবেশি চলছে, থেমে নেই কিছুই। এ অবস্থায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন খুলে দেওয়া হয়।

(বাঁ থেকে) রুবায়না রশিদ রিপা, ইসমাম হোসেন মবিন, মো. শামীম মিয়া ও রাকিবুল ইসলাম

তিতুমীর কলেজের আরেক শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ঘরে বসে আর কতোদিন! পড়ালেখা থেকে দূরে আছি বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে অনেক ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে। মা-বাবাও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাই সুপার শপে কাজ নিতে হয়েছে। জানি না ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে। এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পড় হবে, ভাবিনি কখনো।

রাকিবুল বলেন, একবছর পেরিয়ে গেছে। নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদের তো এতদিনে উপলব্ধি করা উচিত যে করোনা পরিস্থিতিকে কিভাবে যৌক্তিকভাবে মোকাবিলা করা উচিত। সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের জীবন আজ অনিশ্চয়তার মুখে। নীতিনির্ধারকরা এ পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে না ভাবলে আমরা কোথায় গিয়ে দাাঁড়াব!

অনলাইনে-অফলাইনে বেশ কিছুদিন হলো শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য সরব হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে গত ২৫ মে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানার নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন হয়েছে। ক্যাম্পাস খুলে দেওয়াসহ অন্যান্য দাবি না মানলে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দেন মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। এর আগের দিনই জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। ‘ছাত্র সমাজকে বাঁচান’, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন, নয় তো গলায় দড়ি দিন’— এরকম বিভিন্ন বক্তব্য ছিল মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের।

চলমান পরিস্থিতিতে কর্মে নিয়োজিত হয়ে সেটিও ঠিকমতো করতে পারছেন না বলে সারাবাংলাকে জানালেন কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী মো. শামীম মিয়া। তিনি বলেন, পড়ালেখা শেষ করতে পারছি না। কিন্তু বেকার জীবনে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। নিজের দক্ষতা ও সময়টুকু কাজে লাগাতে চাকরি নিলাম। কিন্তু সেখানেও অনেক ঝামেলা।

পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে শামীম বলেন, দিনের পর দিন কলেজ বন্ধ থাকায় গ্রামে চলে যাই। সেখানে গিয়ে একটি চাকরিতে ঢুকেছিলাম। এর মধ্যে আচমকা পরীক্ষার ঘোষণা আসে, রেজিস্ট্রেশনের তারিখ দেয়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু পরীক্ষা আর হয়নি। রেজিস্ট্রেশন করে আবার বাড়ি চলে যাই। আগের চাকরি ততদিনে নেই। কাজ পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইসমাম হোসেন মবিন  বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামের বাড়িতে আছি। পড়ালেকা বলতে গেলে হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে, তা তো কেউ বলতে পারছে না। শুধু বারবার তারিখ বদলাচ্ছে। মনে হচ্ছে আর খুলবেই না। এ অবস্থায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছি। কিন্তু শিক্ষাজীবন নিয়ে গভীর শঙ্কার মধ্যে আছি। জানি না সামনে কী হবে। আমার নিজেরটা তো শুধু না, দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনই চরম অনিশ্চয়তায়। দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাতে এই প্রায় দেড় বছরে যে ধ্বস, তা আদৌ কাটিয়ে ওঠা যাবে কি না, জানি না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাকীত্ব, হতাশা জন্ম নেওয়াকে স্বাভাবিক মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠগ্রহণ ও সৃজনশীল কাজকর্মে নিয়োজিত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

তৌহিদুল হক বলেন, করোনাকালের এই যে সমস্যা, এর মুখোমুখি সারাবিশ্ব। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে উদ্বুদ্ধ করেছি। তারা যেন নিজের বই-পুস্তকে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজেদের জ্ঞানকে বাড়ানোর জন্য পড়ালেখার পরিধি বাড়ায়, সেটি করতে বলছি। সহপাঠ্য কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা বাড়াতে বলছি।

তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার বা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ অপরাধ প্রবণতায় যুক্ত হচ্ছে। হতাশা, একাকীত্ব থেকে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের জন্য কষ্টের জায়গা। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ঘরবন্দি সময়ে পছন্দের কাজগুলো করা, সময় উপভোগ করতে বিনোদনমূলক কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া— এগুলো করতে হবে। এর মাধ্যমে হয়তো তাদের মনোজগতের অস্থিরতা কেটে গিয়ে স্বস্তি ফিরতে পারে।

সমাজ ও অপরাধ বিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হওয়াটা ভালো দিক। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে, শিক্ষাজীবন শেষ হচ্ছে না বলে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের পক্ষ থেকে যে চাপ, আমি বলব এটি একরকম সামাজিক ব্যধি। সামাজিত প্রেক্ষাপট থেকে এই ধারণা পরিবর্তন করা দরকার। একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়, সবাই মিলে পরিস্থিতিকে প্রতিহত করা বা মোকাবিলা করার কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে আমাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে হবে।

সারাবাংলা/এনএসএম/টিআর

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাব্যবস্থা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর