সুইডেনের আগ্রহকে কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ
২৯ মে ২০২১ ২২:৩১
ঢাকা: বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি শক্তিশালী করতে এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে উত্তর ইউরোপের বৃহৎ রাষ্ট্র সুইডেন। পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত সুইডিশ একাধিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে সুইডিশ সরকার জানিয়েছে যে, ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলেও সুইডেন বাংলাদেশকে রুলস অব অরিজিন’র ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় ও কোটামুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত রাখবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুইডেনের আগ্রহকে আমরা কাজে লাগাতে চাই।’
ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে এবং বিনিয়োগ ইস্যুতে সুইডেন আমাদের কীভাবে সহযোগিতা করতে চায়? এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সমতার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সুইডেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সুইডেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে এগিয়ে এসেছে। উন্নয়ন সহযোগিতার মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল সময়ের বিবর্তনে আজ তা বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে সুইডেনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক উন্নততর হয়েছে এবং তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের জুনে সুইডেন সফর করেছেন। সরকার প্রধান হিসেবে এটি ছিল দুদেশের মধ্যে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সরকারি সফর। অত্যন্ত ফলপ্রসূ এ সফরের মধ্য দিয়ে দেশ দুটির সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উঠেছে এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। ওই সফরের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দুদেশের মধ্যে প্রথম ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’ অনুষ্ঠিত হয়।”
রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ৫০টির বেশি সুইডিশ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। রুলস অব অরিজিন’র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনের কাছে বিশেষ ছাড় ও কোটামুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়ে আসছে। ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলেও সুইডেন বাংলাদেশকে একই ধরণের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আভাস দিয়েছে। করোনা অতিমারীকালীন দুর্যোগ একসঙ্গে মোকাবিলা বিষয়ে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফভেন গত বছরের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। সুইডিশ পোশাক আমদানিকারক কোম্পানিগুলো এই অতিমারির সময়েও বাংলাদেশ থেকে সবধরনের পোশাক আমদানি অব্যাহত রেখেছে।’
পরিবেশ বান্ধব টেকসই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় সুইডেন প্রযুক্তি বা টেকনোলজিসংক্রান্ত কোনো সহযোগিতা করতে চায় কি না? চাইলে সেটা আমাদের কীভাবে দিতে চায়? এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব টেকসই অর্থনীতির জন্য সুইডেন বেশ প্রসিদ্ধ। এক্ষেত্রে দেশটি থেকে আমাদের প্রযুক্তিগত ও কারিগরী ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ বিদ্যমান। বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব সম্ভাব্য ক্ষেত্র ও বিনিয়োগের উপায়গুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য সুইডিশ সরকার ইতোমধ্যে একটি গবেষণাধর্মী প্রকল্প নিয়েছে। বিজনেস সুইডেন (Business Sweden) নামের প্রকল্পটির প্রতিবেদন এই বছরের মধ্যে তাদের সরকারের কাছে পেশ করবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও বেশকিছু সুইডিশ কোম্পানি নিজ উদ্যেগে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়িত্বের (Corporate Social Responsibility- CSR) কার্যক্রমের আওতায় এ ব্যপারে বাংলাদেশে পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে।’
দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সুযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার বেশ সুযোগ রয়েছে। দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে পারে এমন খাতগুলো হচ্ছে- এনার্জি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর পরিকল্পনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি বিশুদ্ধকরণ, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, গবেষণা ইত্যাদি।’
করোনা মহামারি আসার আগে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আসছিল উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘শুধুমাত্র বিশ্বখ্যাত সুইডিশ কোম্পানি এইচ অ্যান্ড এম (H & M) প্রতিবছর তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। এসব পণ্যের খুব কম অংশই সুইডেনে আসে। ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয় না। একইভাবে বিশ্বখ্যাত সুইডিশ আসবাবপত্র কোম্পানি ইকেয়া (IKEA), বিখ্যাত সুইডিশ পোশাক কোম্পানির মধ্যে লিনডেক্স (LINDEX), খ্যাপ্পল (KappAhl), জিনাত্রিকোয়া (Ginatricot) বিশ্বের অনেক দেশে অবস্থিত তাদের শাখাগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রয় করছে। যা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সংখ্যায় প্রতিফলিত হয় না।’
এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ড্রা বার্গ ভন লিন্ডে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুইডিশ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, কিন্তু তারা ব্যবসায়ীক মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের প্রতিনিয়ত সময়োপযোগী পর্যালোচনা চায়। সুইডেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে ৫০ বছরের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে চায়।’
গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ-সুইডেন ‘রাজনৈতিক পরামর্শক (পলিটিক্যাল কনসালটেশন)’ সংক্রান্ত বৈঠক করে। ওই বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে উভয়পক্ষ একমতে পৌঁছেন। এরপর চলতি বছরের মার্চে সুইডিশ উন্নয়নমন্ত্রী ফার ওরসন ফ্রিধ বাংলাদেশ সফর করে দুই দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে বিনিয়োগ ইস্যুতে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দেন।
দেখা গেছে, চলমান করোনা সংক্রমনের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে গত ২৮ এপ্রিল ফরেন অফিস বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সুইডেনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে গত ৫ মে সুইডিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন সংক্রান্ত এক বৈঠক হয়। তার আগের দিন সুইডেন-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত নাজমুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে দুই দেশের বাণিজ্য ইস্যুতে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার কথা হয়। এ সময় রাষ্ট্রদূত সুইডিশ ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ কী কী ছাড় বা সুবিধা দিতে পারে তা বিস্তারিত জানান। এছাড়া গত ৭ মে রাষ্ট্রদূত সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বিভাগের প্রধান সিসিলিয়া রুইসট্রম-রুইনের সঙ্গে তার দফতরে সাক্ষাৎ করেন।
জানা গেছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দু’দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৬৪৭ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানির পরিমাণ ৫৮৪ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৬৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৬৮ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন বাংলাদেশ থেকে রফতানি ও আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৯৬ দশমিক শূন্য ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৭২ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সারাবাংলা/জেআইএল/পিটিএম