ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতি কাটিয়ে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ
৩০ মে ২০২১ ১৬:৪৪
প্রায় পনের মাস ধরে করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে দেশের মানুষ। গত বছরও করোনাকালে ঠিক এ সময়ে উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে আঘাত হানে সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ বছরও করোনাকালে একই সময়ে আসে ইয়াসের খবর! একবছর আগে ঘটে যাওয়া স্মৃতিকে ফের চাঙ্গা করে তুলবে না তো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস? মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে নাতো? সেই প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দেয় সবার। কিন্তু না, বাংলাদেশের উপর সদয় হয় প্রকৃতি। পশ্চিমবঙ্গ উপকূল দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের উত্তর উপকূলে স্থলভাগে আছড়ে পড়ার পরপরই শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে যায় ইয়াস। ইয়াসের প্রভাব থেকে বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ মুক্ত।
ইয়াস সম্পর্কে বলা হয়, গতবছরের সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের চেয়ে এর আয়তন ছিল বড়। তাই ইয়াসের শক্তিও বেশি। ইয়াসের ব্যাসার্ধ ৬০০ কিলোমিটার। তার মানে ইয়াস প্রায় ১২০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরাও বলেন, ‘জী হ্যাঁ। ইয়াস শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বটে। যেহেতু আম্পানের চেয়ে ইয়াসের ব্যাস বেশি, সেহেতু এই সাইক্লোনের তীব্রতা আম্পানের চেয়ে অবশ্যই বেশি হবে। ইয়াস সিভিয়ার সাইক্লোনের চেহারা নিতে পারে।’ যার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হবে বলে সতর্ক করা হয়। বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা না থাকলেও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য ও ভরা পূর্ণিমার জোয়ারকালে ইয়াসের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করায় বাংলাদেশে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আরও বেশি দেখা দেয়। সত্যি হয় পূর্বাভাস। ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে জোয়ারের পানি বাড়ে। অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধগুলোও ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ।
এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত দেশে ইয়াসের আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এখন ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তা মোকাবিলার পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। এ ধরনের দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পেতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। পাওয়া তথ্যানুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বৃদ্ধি পায়। নিম্নাঞ্চলের চর প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। উপকূলীয় উপজেলাগুলোর মধ্যে- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, নোয়াখালী, শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি, কমলনগর ইত্যাদি এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি ইয়াসে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল সবসময় প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার। তথ্যমতে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার। এই সুন্দরবনে ঘুর্ণিঝড় বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ঝড়ের বেগ অনেক কমে যায়। সুন্দরবন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঢালস্বরূপ বর্মন হিসেবে কাজ করে। এবার ইয়াসের প্রভাবে সুন্দরবনের বনাঞ্চলের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটা এখনই বলা মুশকিল। তবে সিডর, আইলা, রিজভি, লাইলা, মোরা, তিতলি, ফণী, নার্গিস, বুলবুল, আম্পান এবং সর্বশেষ ইয়াসের ছোবল থেকে মায়ের মতো নিঃস্বার্থভাবে এবারও সুন্দরবন উপকূলবাসীকে আগলে রাখে। অপরাজেয় এই বনের কাছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় মাথা নত করেছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের ভেতরে থাকা মিষ্টি পানির পুকুরে লবণ পানি ঢুকেছে। এটাই বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। সুন্দরবনের প্রাণীদের ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনো অজানা। তবে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে লোকালয় থেকে একটি হরিণ উদ্ধার করার খবর জানা গেছে।
উপকূলে সুন্দরবন ছাড়াও রয়েছে নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্র সৈকত ৩১০ কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চল। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে বিস্তৃত উপকূলেই দেশের প্রধান তিনটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, মোংলা ও (চলমান) পায়রা। দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদানও এ অঞ্চলের। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে গড়ে ৭৪৩ জন। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতিনিয়ত ইয়াসের মতো দুর্যোগের আঘাতে উপকূলের কোটি কোটি মানুষের জীবন, সম্পদ, মর্যাদা তথা বেঁচে থাকার অধিকারটুকু বিপন্ন হয়ে পড়ে।
গবেষকরা জানান, ‘১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯ বার। বারবার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত দেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে গড়ে ৫-১০ বছর পরপর। কিন্তু বৈশ্বিক আবহাওয়া বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশে বিগত ৪৯ বছরে ১৫৪টি আবহাওয়া ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেছে। যা তুলনামূলক ঘন ঘন বৈকি!’ ঘূর্ণিঝড় হলেই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর আসে। এবারের ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবেও অনেকগুলো জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে। গবেষকদের মতে, ‘আমরা এখন যেভাবে রাস্তা বানাই, বাঁধ তৈরি করি, তা স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে যাচ্ছে। ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলা করতে হলে আমাদের আইনের শাসনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে পরিকল্পনা করতে হবে।’
পরিসংখ্যানে প্রকাশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ১৬ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে উপকূল এলাকায় রয়েছে ৫ হাজার ৭৯৭ কিলোমিটার। এসব বাঁধ অনেকটাই পুরনো। সেগুলো পুনঃনির্মাণ, প্রশস্ত ও উঁচু করা দরকার। বিশেষজ্ঞের মতে, উপকূলীয় নদ-নদীর ভাঙন প্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করে বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার জরুরি। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে ৬ থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিটার বাঁধ উঁচু করা দরকার। উপকূলীয় বাঁধগুলো টেকসই এবং নির্মাণ কাজ যথাযথ তদারক করা হলে আগামী ১০০ বছরেও এ বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। টেকসই বাঁধ নির্মিত হলে উপকূল ও উপকূলের চরাঞ্চলের জীবন ও জীবিকার গতি বাড়বে। আশার কথা, সরকার এজন্য ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় টেকসই বাঁধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে সব উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোয় মূল চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য সহায়তা দেওয়া। বাংলাদেশ সরকার এজন্য আগে থেকেই সচেতন। সরকারি সাহায্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। গোখাদ্য ও শিশু খাদ্যের জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। করোনা মোকাবিলায় বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। ঠিক একইভাবে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পুনর্বাসনে সরকার আরও মনোযোগ দেবে বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা। করোনাকালে আমাদের নিজেদের সম্পদ দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে দুর্যোগ সৃষ্ট পরিস্থিতি। আমাদের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে থাকতে হবে সতর্ক। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এনজিও এবং সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকার মানুষের পুনর্বাসনে, তাদের সহায়তায় সর্বোত্তম প্রচেষ্টা করা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকেই এমন ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করে আসছে মানুষ। মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির উপকূলে বাংলাদেশ হওয়ায় এদেশে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ‘চ্যানেল’ হিসেবে বেছে নেয়। বারবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে উপকূলবর্তী মানুষের। তবে সচেতনতা, সু ব্যবস্থাপনার অভাবে একযুগ আগে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জীবন ও সম্পদ হানির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। দিন বদলে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় শেখ হাসিনা সরকার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। করোনার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা, বেড়িবাঁধ মেরামতসহ সার্বিক পুনর্বাসনে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৮টি যুদ্ধজাহাজ, উপকূল এলাকাগুলোতে অত্যাধুনিক বোট, মেরিটাইম পেট্রোল অ্যায়ারক্রাফট ও হেলিকপ্টারের তিনস্তরের জরুরি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে চলেছে। হতাহতদের যথাসময়ে হাসপাতালে কিংবা দুর্গতদের নিরাপদ স্থানে সরাতে সদা প্রস্তুত থেকে কাজ করছে কুইক রেসপন্স টিমের গাড়িও। নৌবাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ত্রাণ ও জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য প্রত্যন্ত ইউনিয়নেও মেডিকেল টিম কাজ করে চলেছে।
গবেষকদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সফলতা এসেছে মূলত আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ থেকে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষেত্রেও আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ইয়াসের আগে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আবার সবাইকে সতর্ক করছি। আরেকটা ঘূর্ণিঝড় কিন্তু আসছে। আর সেই বিষয়ে পূর্ব সতর্কতা আমরা নিতে শুরু করেছি। এতে আমরা সতর্ক থাকব, এই ঝুঁকি হ্রাস করতে পারব।’ রাষ্ট্রনায়কের এমন সতর্কতার ঘোষণা ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় সত্যিই প্রেরণা জোগায়।
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও সকল আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সদা তৎপর বাংলাদেশের আবহাওয়া বিজ্ঞানীগণ। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি হওয়ায় দূর্যোগ পূর্বাভাসে সক্ষমতা বেড়েছে। মহাকাশে উড়ছে জয়বাংলা খচিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’। সেখান থেকে দুর্যোগকালীন সময়ে সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও অত্যাধুনিক নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক ও সময়োচিত পূর্বাভাস দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার কাজে সচেষ্ট বর্তমান বাংলাদেশ। আগে থেকে বাংলাদেশে আবহাওয়া দফতরের নিখুঁত পূর্বাভাসের কারণে প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। পূর্বাভাসের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন ও সতর্ক করায় জীবন ও সম্পদ হানির পরিমাণ আগের চেয়ে বহুলাংশে কমে গেছে। ইতিপূর্বে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, ফণী ও আম্পানের ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কারণে।
উল্লেখ্য, বাংলার মানুষের জানমাল রক্ষায়, ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলে ১৭২টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করেছিলেন। উপকূলের মানুষ এর নাম দেয় মুজিব কেল্লা। তারই আলোকে শেখ হাসিনা সরকার ইতোমধ্যে ৩৭৮টি মুজিব কেল্লা, আর ৩৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করে। এছাড়া আরও ১৬৫০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করার প্রস্তুতি চলছে।
এবারে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে হতাহতের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় রাখার লক্ষ্যে গতবারের চেয়ে তিনগুণ বেশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। উপকূলীয় এলাকায় শতভাগ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা ও দুর্যোগে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত রাখা হয় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। এর মধ্যে ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবক, ২৪ লাখ আনসার ভিডিপি, ১৭ লাখ স্কাউটস, ৪ লাখ বিএনসিসি আর গার্লস গাইডের প্রায় ৪ লাখ সদস্য তো রয়েছেই। যারা সবাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং যেকোনো দুর্যোগের সময় উপস্থিত হয়ে কাজ করে থাকেন। উপকূলীয় মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করেন তারাই। উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া, মানুষ ও গবাদিপশুকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া, কেউ যেতে না চাইলে তাকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ ও পশুর প্রাণহানি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এতসব সু-ব্যবস্থাপনার কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগে আজকাল যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়ে থাকে। ইয়াসসহ সর্বশেষ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারা থেকেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় আজকের বাংলাদেশের যথেষ্ট অগ্রগতি ও অর্জনের প্রশংসা সারাবিশ্বে স্বীকৃত। বাংলাদেশ বিশ্বে শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাতেও রোল মডেলের সম্মান অর্জন করেছে। এবার করোনাকালে ইয়াসের মতো এ ধরণের বড় বিপর্যয় একক প্রচেষ্টায় কাটিয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে আবার দেখিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে- আমরা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য রাখি। জয় করে ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতি, বাংলাদেশে ফিরবে উন্নয়নের গতি। এই হোক সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/পিটিএম