পৌরসভা আলোকিত প্রকল্পে ‘হরিলুট’, খোদ মেয়রই ‘অন্ধকারে’
৩১ মে ২০২১ ০৮:০২
যশোর: যশোর পৌরসভা আলোকিত করতে পৌরসভার ২ হাজার ৭০০ পিলারে লাগানো এলইডি লাইট সজ্জিতকরণ প্রকল্প নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীরা জানান, কম দামে লাইট লাগিয়ে বেশি দাম দেখানো, পুরোনো লাইট দিয়ে নতুনের দাম নেওয়া, রিপ্লেসমেন্ট বা রিপেয়ার করার কথা বললেও সম্পূর্ণ নতুনের দাম ধরা হয়েছে।
এছাড়া সাড়ে ৩ হাজার ৩০০টি লাইট কেনার কথা হলেও এই সংখ্যা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন ছিল, প্রশ্ন ছিল এর স্বচ্ছতার প্রক্রিয়া নিয়ে।
খোদ মেয়র হায়দার গনী খান পলাশ জানাচ্ছেন, পুরো প্রকল্পের বিষয়ে তিনি নিজেই অন্ধকারে। সাড়ে ৩ হাজার টাকার লাইটে সাড়ে ২৪ হাজার টাকা বিলও দেখানো হয়েছে!
পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যশোর পৌর এলাকায় ৮৮০০টিরও বেশি বিদ্যুৎ পিলার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার পিলারে লাইট লাগানো। এসব লাইট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নিয়মে ও প্রকল্পের আওতায় হয়েছে। একসময় সোডিয়াম লাইট, হ্যালোজেন লাইট, মার্কারি লাইট, সাধারণ পাওয়ারফুল বাল্ব, রড লাইট দেখা যেতো। হাজার ওয়াটের লাইটও ছিল কোথাও কোথাও। সেগুলিতে বিদ্যুৎ ব্যয় হতো বেশি, কেটে যেত বা নষ্ট হতো তাড়াতাড়ি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি লাইট চালু হতে থাকে। যশোর পৌরসভাও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত আলোক ব্যবস্থায় সংযুক্ত হতে শুরু করে। ১৮ ওয়াটের এলইডি লাইট দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু।
সাবেক মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু ২০১৬ সালে দায়িত্ব নিয়ে উন্নয়ন খাত, সরকারি, বেসরকারি এবং বিশ্বব্যাংকসহ অনেক সংস্থার দেওয়া কর্মসূচির মাধ্যমে পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন। এরই একটি দিক ছিল পৌরসভাকে আলোকিত করা। সে অনুসারে ২০১৭-২০১৮ সাল থেকে বেশি পাওয়ারের ‘এলইডি লাইট লাগানো প্রকল্প’ গ্রহণ করে।
পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, ১০০ ওয়াট ও ৬০ ওয়াটের প্রায় সাড়ে ৩৩০০ এলইডি লাইট কেনা হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে ঢাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই লাইটগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং ২৭০০ শতাধিক পিলারে এই লাইট লাগানো হয়। লাইট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাইফ পাওয়ারটেক কোম্পানি অন্যতম। এছাড়া বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজও মালামাল সরবরাহ করেছিল।
এসব ১০০ ওয়াটের প্রতিটি এলইডি লাইটের মূল্য দেখানো হয়েছে সাড়ে ২৪ হাজার টাকা আর ৬০ ওয়াটের প্রতিটি লাইটের দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া সেটআপ, পরিবহন, প্রতিস্থাপন ব্যয়ও আলাদা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এদিকে ২ বছরের ওয়ারেন্টির লাইটগুলো খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হতে শুরু করে। ওয়ারেন্টির আওতায় কোম্পানি ৩০০টি লাইট পুনরায় সরবরাহ করে তাছাড়া ওয়ারেন্টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে যশোর পৌরসভা ৩০০ লাইট নিজ প্রতিষ্ঠানের খরচে প্রতিস্থাপন করে। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩৩০০ লাইটের মধ্যে ৬০০ লাইট (প্রায় ২০ শতাংশ) মেয়াদের আগে-পরে নষ্ট হয়।
নষ্ট হওয়া ১০০ ওয়াটের এলইডি লাইটের স্থলে ১৮ ওয়াটের বাল্ব ঝুলতে দেখা গেছে কোনো পিলারে। পৌরসভার বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি লাইট রিপ্লেস করতে চিপ ব্যালাস্ট কিনতে হয়, সেটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই পিলারে তাৎক্ষণিক এসব বাল্ব লাগানো হয়।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানদের অন্যতম সাইফ পাওয়ারটেকের এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার হাবিবুর রহমান মোবাইলে জানান, ১০০ ওয়াটের এ জাতীয় লাইট কোয়ালিটি ভেদে তারা সাড়ে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় সরবরাহ করে থাকেন। এরপর তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে কথার সুর একটু পাল্টে ফেলেন।
তিনি বলেন, ‘জানেন তো, চীন থেকে এখন যেকোনো পণ্য যেকোনো মানে তৈরি করানো যাায়। যশোর পৌরসভার লাইটগুলো আলাদা টেকনিক্যাল ইন্সট্রাকশন দিয়ে স্পেসিফিকেশনে তৈরি করিয়েছি। এর মান ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ড।’ তবে এত তাড়াতাড়ি নষ্ট, পরিবর্তন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে গেলেন।
অভিযোগ-অনিয়মের বিষয়ে বর্তমান মেয়র হায়দার গনী খান পলাশ জানান, এটা নিয়ে তিনি যন্ত্রণায় আছেন। এর কোনো সঠিক হিসেব তিনি পাচ্ছেন না। পৌরসভার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনটি বিষয়ের সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না, তার মধ্যে লাইট প্রকল্প একটি। সবই একক হাতে হয়েছে, একজনের পকেটে সব টাকা গেছে। টেন্ডার থেকে শুরু কর পুরো প্রক্রিয়াটিই অনিয়মে ভরা।
মেয়রের অভিযোগ, ১০০ ওয়াটের এসব লাইটের বাজার মূল্য কোম্পানি এবং মানভেদে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৭ হাজারের মধ্যে অথচ সাড়ে ২৪ হাজার দেখানো হয়েছে প্রতিটি লাইটে। শুধু তাইই নয় বদল বা রিপেয়ার দেখিয়েও পুরো নতুনের দাম তোলা হয়েছে। লাইট কেনার সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
মেয়র বলেন, ‘পুরো প্রকল্পে একক ব্যক্তি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে ফলে সব বিষয়েই অনিয়ম হয়েছে এবং যে বিপুল অঙ্কের ব্যয় দেখানো হয়েছে তার কোনোটাই সঠিক নয়। তারপরও তা অনুমোদন দেওয়াসহ পুরো বিষয়টিকেই নিয়মমাফিক দেখানো হয়েছে। ফলে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে বা কতটুকু স্বাভাবিক।’
সারাবাংলা/এমও