পোশাক খাতে বাড়তি প্রণোদনা, কর কমানোর দাবি কারখানা মালিকদের
৩১ মে ২০২১ ২২:০০
ঢাকা: পোশাক খাতের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে আরও প্রণোদনা চেয়েছেন মালিকরা। নতুন করে নন-কটন গার্মেন্টস রফতানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ প্রণোদনা চেয়েছে তৈরি পোশাক খাতের প্রভাবশালী ও সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতনিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। একইসঙ্গে প্রণোদনার (ইনসেনটিভ) ওপর ১০ শতাংশ হারে যে আয়কর রয়েছে, সেটিও প্রত্যাহারের দাবি রয়েছে সংগঠনটির। উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করার দাবিও জানিয়েছেনে পোশাক কারখানার মালিকরা।
এদিকে, নিটওয়্যার পণ্যের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র দাবি— মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপিকে করের আওতামুক্ত রাখারও দাবি রয়েছে এই সংগঠনটির। একইসঙ্গে শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি করছে বিকেএমইএ।
এছাড়াও রফতানিমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যমূলক করপোরেট করের (একই রকম করপোরেট কর) দাবি রয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)।
বাজেটে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সারাবাংলাকে বলেন, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পোশকসহ ব্যবসায় খাতে সরকার নীতি সহায়তা দিয়ে আসছে। এবারের বাজেটেও তা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য যে ঋণ নিয়েছি, তা ২ বছরে ১৮ কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু আমরা ৩ বছরে ৩০ কিস্তিতে তা পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করছি। আর আমরা যে প্রণোদনা পাই, তার ওপর ১০ শতাংশ আয়কর আছে। আমরা এ ক্ষেত্রে আয়কর শূন্য করে দেওয়ার প্রস্তাব করছি। প্রণোদনায় তো আর আয়কর থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে পোশাক খাতে উৎসে কর রয়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ। এই উৎসে কর কমিয়ে আগামী ৫ বছরের জন্য তা দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি। ব্যবসার ক্ষেত্রে পলিসি স্ট্যাবিলিটি দরকার। তাই করপোরেট কর দীর্ঘসময় ধরে একই রাখার প্রস্তাব করছি, যেন ব্যবসার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা যায় (বর্তমানে সাধারণ কারখানার ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর ১২ শতাংশ ও সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ)।
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, নন-কটন গার্মেন্টেস রফতানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ প্রণোদনা চাচ্ছি আমরা। এটি হলে আমরা নতুন অর্ডার পাব, বাজার সম্প্রসারিত হবে। ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের কারখানাগুলোকে ক্ষুদ্র কারখানা বলা হয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষুদ্র কারখানা বলা হোক। নতুন মার্কেটে আমরা ৪ শতাংশ প্রণোদনা পাই, তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করতে আমাদের প্রস্তাব রয়েছে। ছোট অনেক কারখানা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে না। তাদের মধ্যে কেউ ব্যবসা করতে চায়, আবার কেউ বেরিয়ে যেতে চায়। তাই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য (এক্সিট) বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখতে হবে।
জানতে চাইলে দেশের নিটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানির ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে। আবার যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। কেউ মেশিন আনলে সেটি তো দেশের প্রতিষ্ঠানেই ব্যবহৃত হবে। তাই যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা এই বাজেটেই প্রত্যাহার করতে হবে।
ইটিপি স্থাপনে পোশাক কারখানার মালিকদের আগ্রহী করতে হলে এর ওপর থেকে কর প্রত্যাহার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ইটিপি মেশিন আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স রয়েছে। এই মেশিন ব্যবহারের ফলে দেশ পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাবে, অথচ এটার ক্ষেত্রেও ভ্যাট-ট্যাক্স। ফলে ইটিপি বসাতে ব্যয় বেশি হয়। এ কারণে ব্যবসায়ীরা অনাগ্রহ দেখান। তাই ইটিপির ওপর বিদ্যমান কর প্রত্যাহার করতে হবে। একে ডিউটি ফ্রি করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিমাসে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হয়। অথচ রফতানির পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট নেই। রফতানি খাত ভ্যাটের আওতামূক্ত। কিন্তু প্রতিমাসে শূন্য ভ্যাটেই আমাদের রিটার্ন দাখিল করতে হচ্ছে। এতে সরকারের এক টাকাও লাভ হচ্ছে না। কিন্তু এই ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে গিয়ে আমাদের অতিরিক্ত লোকবল খাটাতে হচ্ছে। এটি এক ধরনের অপচয়। শূন্য ভ্যাটে যেন আমাদের রিটার্ন দাখিল করতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও কিছু দাবি জানিয়ে বিকেএমইএ’র এই নেতা বলেন, দেশীয় সুতা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা বেশি দামে সুতা কিনছি। অথচ ভারতে এই সুতার দাম আরও কম। আমরা রফতানির ওপর যে প্রণোদনা পাই, তার ওপর ১০ শতাংশ আয়কর রয়েছে। এটি প্রত্যাহার করতে হবে। দেশের সব খাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে এবং বেতন কমিয়ে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের এখানে শ্রমিক ছাঁটাইও হয়নি, বেতনও কমানো হয়নি। আমরা চাই এই মুহূর্তে ইনক্রিমেন্ট সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রাখা। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য বাজেটে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন শ্রমিকরা কম দামে নিত্য পণ্য কিনতে পারে।
রফতানিমুখী খাত হিসেবে করপোরেট করে সামঞ্জস্য চায় বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)। সংগঠনটির সভাপতি আব্দুর কাদের খান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের করপোরেট ট্যাক্স ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র ক্ষেত্রে সেটি ১২ ও ১০ শতাংশ। রফতানির ক্ষেত্রে বলা আছে— যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রফতানি করবে, তারা একই সুবিধা পাবে। তাই আমরা চাই রফতানিমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যমূলক করপোরেট কর। আবার এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় দাবি বা প্রত্যাশা। এছাড়া উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে আমাদের।
বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে— এমন প্রত্যাশা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বাজেট হতে হবে সম্প্রসারণমূলক ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এসএমই খাতে বিশেষ নজর রাখতে হবে। সব মিলিয়ে বাজেট হতে হবে ব্যবসা বান্ধব, যেন সবার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। বাজেটে ভ্যাট ও ট্যাক্সের আওতা বাড়াতে হবে এবং ভ্যাট ও ট্যাক্সের হার কমাতে হবে।
সরকার তৈরি পোশাক খাতের জন্য বাজেটে সহায়তা রাখবে প্রত্যাশা জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন, পোশাক খাত এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন দেশে এখনো মার্কেট বন্ধ রয়েছে। বিশ্বে পোশাক খাতের দুর্দিন যাচ্ছে। সারাবিশ্বের সব মার্কেট খোলেনি। সরকার সবসময় পোশাক খাতকে সহায়তা দিয়ে আসছে। এখন পোশাক খাতের যেখানে যতটুকু সহায়তা দরকার, সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটে সেই সহায়তাও দেওয়া হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট তৈরি পোশাক খাত বাজেট ২০২১-২২ বিকেএমইএ বিজিএপিএমইএ বিজিএমইএ