Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৮ বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করেছে ‘বস রাফি’ চক্র

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ জুন ২০২১ ২২:০৭

ঢাকা: মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোরী-তরুণীদের মডেল বানিয়ে ভারত, দুবাই, সিংগাপুরে উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার আশ্বাস দিত চক্রটি। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরী-তরুণীদের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হোটেল ও বিউটি পার্লারে উচ্চ বেতনের চাকরি ও মডেলিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাত। সেই ফাঁদেই পা দিতেন অনেক কিশোরী-তরুণী। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় তাদের বিক্রি করা হতো। অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ভারতে। গত আট বছরে এভাবেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করেছে একটি চক্র, যা ‘বস রাফি চক্র’ নামে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক এই পাচার চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব)। গ্রেফতার করেছে চক্রের মূল হোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিকে।

মঙ্গলবার (১ জুন) বিকেল সাড়ে ৫টায় কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে র‌্যাব সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মইন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, সস্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় বেঙ্গালুরু পুলিশ দুই নারীসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে তরুণীর বাবা গত ২৭মে হাতিরঝিল থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব তদন্ত শুরু করে।

তদন্তে র‌্যাব জানতে পারে, ভাইরাল হওয়া নির্যাতিত নারী ভারতে পাচারের শিকার হয়েছেন। সেখানে জোর করে তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো হতো। নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা ঝিনাইদহের আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি (৩০)। পরে যশোরের অভয়নগর থেকে বস রাফিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার দেওয়া তথ্যমতে যশোরের বেনাপোল থেকে সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদাসহ আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার বাকি দু’জন হলেন— আব্দুর রহমান ও ইসমাইল সরদার।

অন্যদিকে ভারতে গ্রেফতার হওয়া এই চক্রের ছয় জন হলেন— টিকটক হৃদয় বাবু, সাগর, বাবা শেখ, হাকিল ও তানিয়াসহ দুই নারী।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, বিভিন্ন সময় ফাঁদ পেতে এবং বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের ভারতে পাচার করা হতো। প্রায় ৫০ জন এই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য দিয়েছে তারান। এই চক্রের মূলহোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফি। গ্রেফতার অন্যরা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

বিজ্ঞাপন

র‍্যাব জানায়, টিকটক হৃদয় বাবু অনলাইনে টিকটক ও বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন তরুণীদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। ওই গ্রুপে যেসব তরুণী যুক্ত ছিলেন, তাদের বিভিন্ন সময় মডেল বানানো এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। পরে তাদের ভারতের বিভিন্ন সুপার মার্কেট, সুপার শপ ও বিউটি পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বস রাফি ও অন্যান্য সহযোগীদের মাধ্যমে পাচার করতেন।

ভারতে পাচারের আগে ও পরে একটি সেফ হাউজে রাখা হতো ওই তরুণীদের। সেফ হাউজে তাদেরকে জোর করে ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মাদক সেবন করানো হতো। এরপর জোর করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হতো। তরুণীদের পরে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এগুলো ভিডিও করে রাখা হতো।

র‍্যাব জানিয়েছে—জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, নারীদের বৈধ ও অবৈধ দুইভাবেই পাচার করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগকেই অবৈধ পথে ভারতে পাচার করা হয়েছে। পাচারের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দালালরা জড়িত ছিল। দালালদের এই ক্ষেত্রে লাইনম্যানও বলা হয়। লাইনম্যানর দুই দেশেই রয়েছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথমে দালালদের মাধ্যমে নারীদের সংগ্রহ করা হতো। এরপর তাদের যশোর, বেনাপোল ও ঝিনাইদহ এলাকায় পাঠানো হতো। যাদের পাচার করা হতো তাদের একটি সেফ হাউজে রাখা হতো বর্ডার ক্লিয়ারেন্সের জন্য। লাইনম্যানরা বিভিন্নভাবে বর্ডার ম্যানেজ করত। কখনও কখনও কাঁটাতারের বেড়া কেটে ওপারে পার করা হতো পাচারকারী নারীদের। ওপারে যাওয়ার পর সেখানকার লাইনম্যান তাদের কোলকাতায় নিয়ে রাখত। সেখান থেকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে নিজস্ব সেফ হাউজে রাখা হতো। পাচারের শুরু থেকে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত পৌঁছাতে যে ৫/৬ দিন সময় লাগত, এই সময়ে দালাল চক্রের সদস্যরা নারীদের দফায় দফায় যৌন নির্যাতন করত।

কমান্ডার বলেন, বেঙ্গালুরুতে যে সেফ হাউজগুলো আছে তার অধিকাংশ হচ্ছে বাংলাদেশী নারী পাচার চক্রের মূলহোতা আশরাফুল ওরফে বস রাফির মালিকানাধীন। ভারতে সে বস রাফি নামেই বেশি পরিচিত। তার তত্ত্বাবধানে সবুজ, ডালিমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি সেফ হাউজগুলো দেখাশোনা করে। লোহমর্ষক ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেটা ছিল সবুজের তত্ত্বাবধানে থাকা সেফ হাউজে। বিভিন্ন সাব এজেন্টের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি করানোর জন্য নারীদের সেখানে পাঠানো হতো। পতিতাবৃত্তির যে টাকা আসত তার একটা বড় অংশ বস রাফির কাছে আসত। সবুজদের দায়িত্ব ছিল যাদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানো হতো, তারা যেন কাউকে কোনো কিছু না বলে এবং কোথাও পালিয়ে না যায়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাফি মূলত অষ্টম শ্রেণি পাশ। গত ৮ বছর ধরে সে ভারতে যাতায়াত করত এবং ৫ বছর ধরে নারী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। এইসময়ে সে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছে। টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে বস রাফির পরিচয় হয় দুই বছর আগে। বস রাফি বিভিন্নভাবে পাচার করার জন্য হৃদয়কে নারী সংগ্রহ করতে বলে। হৃদয় বুঝতে পারে টিকটক হলো একটি ভালো মাধ্যম যেখানে নারীদের সহজেই আনা যায়। প্রত্যেক নারী পাচারের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখায় বস রাফি। টিকটক হৃদয় গত দুই বছরে প্রায় ৫০ জন নারীকে পাচার করেছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে তাকে মূলত গত অক্টোবরে বস রাফির মাধ্যমে ভারতে পাচার করা হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে সবুজের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল তাকে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার হওয়া ম্যাডাম সাহিদা বাংলাদেশে সেফ হাউজের সর্দার হয়ে দেখাশোনা করত। আবার তারই দুই মেয়ে ভারতে পাচার হওয়া নারীদের সেফ হাউজে দেখাশোনা করত। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আরেকজন যে নারীকে দেখা গিয়েছে তার নাম তানিয়া। তানিয়া সাহিদার বড় মেয়ে। তার ছোট মেয়েও আরেকটি সেফ হাউজের দেখাশোনা করে। সাহিদাসহ বড় মেয়ে গত ১০ বছর এবং ছোট মেয়ে ৬ বছর ধরে এই চক্রের হয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সাহিদা ও বস রাফি।

আসামিরা জানিয়েছে, তারা ক্ষেত্র বিশেষে অনেক নারীকে পাচারের পরে বিক্রি করে দিয়েছে। এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান। পাচারকারী চক্রের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার আল মইন বলেন, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোলের বর্ডার এলাকায় সেফ হাউজ রয়েছে। এছাড়া বর্ডারের বিভিন্ন স্থানে সেফ হাউজ তৈরি করে পাচারকারী নারীদের রাখা হয়েছিল। তারা যেভাবে পাচার করত সেই বিষয়গুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের জানানো হবে। পাশাপাশি বস রাফি আট বছর বেঙ্গালুরুতে ছিল। সে প্রথমে ড্রাইভার ছিল। অনেক কোম্পানিতে চাকরি করেছে। একসময় সে তামিল ভাষা রপ্ত করেছে। সেই সুবাদে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের শহরগুলোর হোটেলগুলোর ম্যানেজার ও দালালদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে। এরপর নারী পাচারকারী চক্রের প্রধান হয়ে ওঠে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাদের বিক্রি করা হতো, আমরা জেনেছি খুবই সামান্য তাদের বিক্রি করা হতো। মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো। সংগ্রহের সময় পাচারকারীরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যেত। একটি ভাগ একটু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের মডেল হওয়ার লোভ দেখাত। তাদের ভারত দিয়ে দুবাই বা আরও ভালো কোনো দেশে পৌঁছে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করত। আরেকভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ভারতের বিভিন্ন হোটেলে, বিউটি পার্লার ও মডেল হওয়ার প্রলোভন দেখাত এবং তাদের পাচার করত।

আরেক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তিনি ছাড়াও সবুজের সেফ হাউজে মগবাজারের আরও দুই নারী ছিলেন। নির্যাতনের শিকার নারী তাদের দু’জনকে নিয়ে গেছেন। নির্যাতিত ওই নারীর বিরুদ্ধেও মানবপাচার আইনে মামলা হতে পারে।

সারাবাংলা/ইউজে/এসএসএ

‘বস রাফি’ চক্র টপ নিউজ ভারতে নারী পাচার

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর