Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবন-জীবিকার বাজেট আসছে আজ

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ জুন ২০২১ ০০:৩৫

ঢাকা: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মেলেনি। অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাতও কাটেনি। বেশকিছু গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার কারণেই অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা এই করোনার অভিঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার। দেশের সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে বিশেষত এই প্রান্তিত জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়েই আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার তৃতীয় এই বাজেটের শিরোনাম রেখেছেন ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’।

আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেট, তথা দেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম, শেখ হাসিনা সরকারের ১৯তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৩তম বাজেট।

আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়েই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হবে। এ বাজেটে সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষকে সঙ্গে রাখা হবে।

বাজেটে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব

এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্রাকেজ বাস্তবায়ন, কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর থাকছে। এছাড়াও আগামী অর্থবছরের পুরো সময়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বাড়ানো হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। সেই সঙ্গে থাকছে করোনা পরবর্তী  অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের রূপরেখা, নতুন কর্মসংস্থান সৃজন।

আগামী বাজেটে থাকছে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে স্বল্প ও বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের উদ্যোগ। প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়নে বিভিন্ন দিক  নির্দেশনা এবং বাড়তি খাদ্য উৎপাদনে কৃষিতে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিও থাকছে। সেই সঙ্গে এবারই প্রথম দেশের ১৫০টি উপজেলার বয়স্কজন ও বিধবা নারীদের ভাতা দেওয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বাড়বে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা।

বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে

মহামারি কোভিড প্রতিরোধ বিবেচনায় নিয়ে এবার স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করেছে সরকার। প্রথমবারের মতো মোট বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে, যা চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই খাতের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।

কোভিড আক্রান্ত কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান, সে লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিকায়নের সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়।

৮ খাতে অগ্রধিকার

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে আটটি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কোভিড নিয়ন্ত্রণে অর্থায়ন ও স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রাসরণ করা, প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়ন, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে স্বল্প ও বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, বাড়তি খাদ্য উৎপাদনে কৃষিতে গুরুত্ব প্রদান, মানবসম্পদ উন্নয়ন। এছাড়াও সরকার কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোরও উল্লেখ থাকবে বাজেট বক্তৃতায়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, এসএমইসহ সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষায় বাজেটে থাকবে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এতে করে কোভিড-১৯ পরবর্তী কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি নতুন করে করহার না বাড়িয়ে করজাল বিস্তৃতির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা থাকবে বাজেটে।

বাজেটের আকার

আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপি’র আকার ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এটি চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা এবং  চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি।

বাজটে জিডিপি‘র প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। প্রথমবারের মতো জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি ঘাটতি ধরে চূড়ান্ত করা হয়েছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দা চলছে। যে কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি খুব বেশি হবে না— এমন হিসাব থেকে আগামী বাজেটে এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও  মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাজেটের আয়-ব্যয় ও ঘাটতি

মহামারি কোভিড মোকাবিলায় সরকারকে বেশি আয় করে বেশি ব্যয় করতে হবে। এই বিবেচনায় সরকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। কোভিডকালীনও বাজেটে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি জিডিপির ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান নেওয়া হবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

চলতি২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মহামারি কোভিডকালেও চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে চায় সরকার।

সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণে কর খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এই করের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত কর ১৬ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, বৈশ্বিক মহামারি কোভিড আগামী অর্থবছরেও থাকবে— এমনটি ধরেই বাজেটে ব্যয় খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়বে। যে কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ টাকা, ঋণ ও অগ্রিম ৪ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।

ঘাটতি বাজেট যেভাবে পূরণ হবে

কোভিডকালীন আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় আসছে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৫ দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যে রাখা আছে। তবে আগামী বছর অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ৬ দশমিক ১ শতাংশ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণ ঘাটতি পূরণ করা হয় ঋণের মাধ্যমে। কোভিড-১৯ এর কারণে বিভিন্ন দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে সহায়তা করছে।

বাজেট সহায়তা হিসাবে আসন্ন বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ঋণ করার কারণে বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এজন্য আসছে বছরে সুদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জীবন ও জীবিকা বাজেট ২০২১-২২


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর