সংসদে ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেট উত্থাপন
৩ জুন ২০২১ ১৫:১৪
ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অভিঘাত মোকাবিলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেট এটিই। বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এই বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী।
এর আগে, বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে ২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপর সেই বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের অনুমতি দিয়ে তাতে সম্মতিসূচক সই করেছেন রাষ্ট্রপতি।
এরপর বাজেট সংক্রান্ত নথিপত্র চিরাচরিত ব্রিফকেসে হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এসময় অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা তাদের স্বাগত জানান।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি। অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাতও কাটেনি। বেশকিছু গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার কারণেই অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা এই করোনার অভিঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার। দেশের সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে বিশেষত এই প্রান্তিত জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়েই আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার তৃতীয় এই বাজেটের শিরোনাম রেখেছেন ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’।
২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেটটি দেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট। আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি টানা তৃতীয় বাজেট। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের এটি টানা ১৩তম বাজেট।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপি’র আকার ধরা হয়েছে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এটি চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা এবং চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। প্রথমবারের মতো জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি ঘাটতি ধরে চূড়ান্ত করা হয়েছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দা চলছে। যে কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি খুব বেশি হবে না— এমন হিসাব থেকে আগামী বাজেটে এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটের আয়-ব্যয় ও ঘাটতি
মহামারি কোভিড মোকাবিলায় সরকারকে বেশি আয় করে বেশি ব্যয় করতে হবে। এই বিবেচনায় সরকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। কোভিডকালীনও বাজেটে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি জিডিপির ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান নেওয়া হবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
চলতি২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মহামারি কোভিডকালেও চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে চায় সরকার।
সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণে কর খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এই করের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত কর ১৬ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বৈশ্বিক মহামারি কোভিড আগামী অর্থবছরেও থাকবে— এমনটি ধরেই বাজেটে ব্যয় খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়বে। যে কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ টাকা, ঋণ ও অগ্রিম ৪ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
ঘাটতি বাজেট যেভাবে পূরণ হবে
কোভিডকালীন আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় আসছে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৫ দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যে রাখা আছে। তবে আগামী বছর অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ৬ দশমিক ১ শতাংশ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণ ঘাটতি পূরণ করা হয় ঋণের মাধ্যমে। কোভিড-১৯ এর কারণে বিভিন্ন দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে সহায়তা করছে।
বাজেট সহায়তা হিসাবে আসন্ন বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ঋণ করার কারণে বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এজন্য আসছে বছরে সুদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর