ব্যবসায়ীদের কাছে বাজেট তাৎপর্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক
৪ জুন ২০২১ ০১:৩৩
ঢাকা: প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে তাৎপর্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজেটের আকার অবাস্তব নয় বলেও মন্তব্য তাদের। তবে প্রস্তাবিত বাজেটকে চ্যালেঞ্জিংও মনে করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এসব কথা কথা বলা হয়েছে।
এদিন জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা কক্ষে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। তাতে সম্মতিসূচক সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপরই সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি তার তৃতীয় বাজেট, বাংলাদেশের ৫০তম।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার অবাস্তব নয় বলে মন্তব্য করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। তবে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি বলে মনে করছে সংগঠনটি।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতি বছর বাড়ছে। তবে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হলো— সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সেভিংস সার্টিফিকেট (সঞ্চয়পত্র) থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা।’ ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব সুলভ সুদে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের প্রচেষ্টা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘বাজেটে করোনা মহামারি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুর্নগঠন, ভ্যাকসিনেশন ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম জোরদারকরণ, কৃষি, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি ২০৩০), প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১), এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গৃহীত কার্যক্রম ও ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় বাজেট প্রণীত হয়েছে। করোনার কারণে কর্মহীনতা ও আয় হ্রাস কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতা কর্মসূচি প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’ এসব বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এই প্রস্তাবিত বাজেটকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এ বছরের বাজেটটি আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটা আমাদের ৫০তম বাজেট। সেই সঙ্গে নজিরবিহীন করোনা মহামারি থেকে অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারে এই বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা এবং নীতি-কৌশল রয়েছে।’
‘একইসঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর এটি প্রথম বাজেট। বিশেষ করে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ,’— বলেন বিজিএমইএ সভাপতি।
বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) জানায়, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি ও জনগণকে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে রক্ষায় বাজেটে উদ্যোগ থাকার কারণে ‘জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা’য় এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট হয়েছে। তবে এত বড় বাজেট বাস্তবায়ন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হবে। তাই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে তারা। একই সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়ন, ঘাটতি মোটানো এবং রাজস্ব আদায় ও সম্প্রসারণে আরও বেশি নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা চেম্বার বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯-এ বিপর্যস্ত, এই কঠিন সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ঘোষিত জাতীয় বাজেট ২০২১-২২ এ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ২ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এই সময়ে এরকম অগ্রগতিমূলক ও অর্জনযোগ্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আমাদের মাঝে আশার সঞ্চার করছে। কোভিডকালীন বাংলাদেশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে সারাবিশ্বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। তাই এ ধরনের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটাতে হবে, যা অনেকাংশে চ্যালেঞ্জিং।
ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের জন্য করের আওতা বাড়ানো, অনাদায়ী কর আদায়, জেলা শহরের রাজস্ব আদায় বাড়ানো, স্বচ্ছতা ও কর প্রদান প্রক্রিয়ায় অটোমেশন প্রয়োজন। বেসরকারি বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখতে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর নতুন করে করের বোঝা আরোপ না করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সেভিংস সার্টিফিকেট, সমবায় নিবন্ধন, পোস্টাল সেভিংসের ক্ষেত্রে ই-টিন বাধ্যতামূলক করায় কর সংগ্রহের আওতা কিছুটা বাড়তে পারে।ৎ
ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানালেও বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ ও জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-সহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বাজেটের সমালোচনা করেছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই বাজেটকে জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সংকটকালীন বাস্তবমুখী বাজেট বলে অভিহিত করেছে।
এদিকে, বাজেট উত্থাপনের দিনটিতে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কেবল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। চলমান করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যেসব স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত ছিল, সেগুলোর উপস্থিতি এই প্রস্তাবিত বাজেটে নেই বলে সমালোচনা করেছে তারা। বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হয়নি বলেও মন্তব্য সিপিডি’র।
সারাবাংলা/পিটিএম/টিআর
অন্তর্ভুক্তিমূলক আকার অবাস্তব নয় বাজেট বাজেট তাৎপর্যপূর্ণ বাজেট স্পেশাল ২০২১-২২