প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ: বিএনপি
৪ জুন ২০২১ ১৩:৩৫
ঢাকা: ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার (৪ জুন) দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। প্রস্তাবিত বাজেটের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই বাজেট বাংলাদেশের মানুষের যেই আশা-আকাঙ্ক্ষা, সেটা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে— এক কথায় এটাই বলব আরকি। ওই গরিব মারার বাজেট-টাজেট— এটা বলতে চাই না। আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
‘এই সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নাই, অ্যাকাউন্টিবিলিটি নাই। সেই জন্য সাধারণ মানুষ যারা আছে, যারা সংখ্যায় বেশি দিন আনে দিন খায়, তাদেরকে খুশি করার কোনো দরকার নেই। যাদেরকে খুশি করলে তাদের (সরকার) দুর্নীতিটা বহাল থাকবে, দুর্নীতি করতে পারবে ঠিক মতো, সেটাই তারা করেছেন। এটা তাদের যে চারিত্রি বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্য মতোই হয়েছে’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিপাদ্য শব্দমালার মাঝেই এবারের বাজেটের ভাওতাবাজি পরিস্কার। কারণ, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন গত ১৮ মাস ধরে অচল। তাই সুস্পষ্টভাবে মানুষের জীবন-জীবিকার কথা মাথায় না রেখে কেবলমাত্র অর্থনীতির নানা তত্ত্ব ও বিশাল সংখ্যার বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে কার্যত জনগণের সঙ্গে এক ধরনের ভাওতাবাজি করা হয়েছে।’
‘সবচেয়ে বড় কথা এই বাজেটেও স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ এই মুহূর্তে মানুষের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, মহামারিকালে মানুষের জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তায় স্বাস্থ্য পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এটি একটি অবাস্তবায়নযোগ্য কাল্পনিক ও কাগুজে বাজেট ছাড়া আর কিছুই নয়।’
প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণকে কোভিডের মহাসংকট থেকে রক্ষার দিক নির্দেশনা নেই অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটি দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট। জনগণের সমর্থনবিহীন সরকারের রাষ্ট্রের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই এ বাজেটে জনস্বার্থের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। এটি দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট।’
তিনি বলেন, ‘এবারের এই বাজেট হয়েছে জিডিপির মাত্র ১৭.৪৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের জন্য মূল বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭.৯০ শতাংশ। এ হিসাবে বাজেটের প্রকৃত আকার বৃদ্ধির পরিবর্তে সংকোচিত হয়েছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাত সম্প্রসারণের নামে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। মধ্যবিত্তদের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি, যা মধ্যবিত্তকে হতাশ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এখানে বলে রাখা ভালো সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও প্রাইমারি স্কুল শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকাও রয়েছে। এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে সহায়তা সরকার দিয়েছে তা ‘লোকদেখানো’। ৫-৬ কোটি মানুষের জন্য মাথাপিছু ১-২ শ’ টাকাও পড়বে না।’
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে, অথচ এ খাতে বরাদ্দ জিডিপির সেই ১ শতাংশের মধ্যেই আছে। এই বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা মিটবে না। অন্যদিকে বরাদ্দ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য খাত পিছিয়ে আছে। করোনার ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা কবে থেকে কার্যকর হবে, কিভাবে হবে, সে সম্পর্কে কিছু নিশ্চিত করে বলা হয়নি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বড় আকারের বাজেট আর বড় অংকের প্রবৃদ্ধির আলোচনা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ৭.২% প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উচ্চাভিলাষ বজায় রেখেছেন। এবার সবাই আশা করেছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার দিকে বেশি নজর দেবে সরকার। অথচ সে জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট রোড-ম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের ওপরে ধরা হয়েছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা কিভাবে হবে বলা হয়নি। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে এক জায়গায় আটকে আছে। কোভিডের কারণে তা আরও কমে গেছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ না হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কিভাবে? শুধু সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে হবে না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অনেক আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। গত এপ্রিলে গড়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৫৬%। এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৩%। এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক নয়। সরকারের প্রক্ষেপণ আর বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই তিন লাখ টাকা থাকছে। বাজারের দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি ও কোভিড পরিস্থিতিতে চিকিৎসার খরচ বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো উচিত ছিল।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মোট বাজেটের এক তৃতীয়াংশের বেশি হল ঘাটতি যা বৈদেশিক অথবা অভ্যন্তরীণ সোর্স থেকেই ঋণের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। বিএনপি অতীতে এদেশকে বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা থেকে বার বার বের করে আনার চেষ্টা করেছে আর আওয়ামী লীগ তাদের বিশৃংখল মেগা প্রকল্প ও মেগা দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতিকে বার বার বৈদেশিক নির্ভর করে দেশের প্রতিটি শিশুর মাথায় জন্মের আগেই হাজার হাজার টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এবারের বাজেট তারই চরম বহিপ্রকাশ।’
তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরটি চালাতে অর্থমন্ত্রী কোন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করবেন? দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। তবে উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকেও ঋণ নেওয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও থাকছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদই দিতে হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় খাতে এডিপি বরাদ্দ কমেনি। লুটপাট ও দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা দিতে এডিপি বরাদ্দ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের মতো বিলাসী প্রকল্পও রয়েছে এই তালিকায়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার গত এক দশকের অধিককাল ধরে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি ও ক্রনিক্যাপিটালিজম এর মাধ্যমে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সীমাহীন দুর্নীতি করে এক নজিরবিহীন অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। আমরা সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ অর্থনীতির অঙ্গীকার চাই, যা এ বাজেটে অনুপস্থিত।’
প্রসঙ্গ খালেদা জিয়া:
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) গতকাল বিকেলে একটা বিশেষ কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। কারণটা হচ্ছে— ম্যাডাম যে সিসিইউতে ছিলেন, সেই সিসিইউতে তার কোভিড-১৯ পরবর্তী কতগুলো রি-অ্যাকশন হয়েছিল এবং আরেকটি রি-অ্যাকশন যেটা খুবই বিপদজনক ছিল। সেটা হচ্ছে তার রক্তে কিছুটা ইনফেকশন হয়েছিল, যেটাকে সিসটোসেনিয়া বলে।’
‘ডাক্তাররা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ইনফেকশনটাকে দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু ওখানে (সিসিইউ) সংক্রমণের সম্ভবনা বেশি, আবারও সংক্রমণ হতে পারে, সেই কারণে তাকে (খালেদা জিয়া) উনারা (চিকিৎসক) বিশেষ কেবিনে স্থানন্তর করেছেন। তিনি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছেন, তা নয় কিন্তু। তার হার্ট, কিডনি, লাংক (ফুসফুস)— এই তিনটা কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও লাংকে এখন তার কোনো সংক্রমণ নেই বা সেই ধরনের কোনো ইনফেকশন নেই, কিন্তু হার্ট এখনো সমস্যার মধ্যে আছে। কিডনিতেও সমস্যা আছে’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
সারাবাংলা/এজেড
২০২১-২০২২ অর্থ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ টপ নিউজ প্রস্তাবিত বাজেট বিএনপি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর