রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব নয়, বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ
৫ জুন ২০২১ ২২:০১
ঢাকা: ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা, তা পূরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। প্রস্তাবিত বাজেটে যতটুকু ঘাটতি রয়েছে, তাকে গ্রহণযোগ্যও মনে করছেন তিনি। তবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে ঘাটতি বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য তার। সার্বিকভাবে সম্প্রসারণমূলক এই বাজেট বাস্তবায়নকে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হয়েছে— শনিবার (৫ জুন) সারাবাংলার সঙ্গে এ সংক্রান্ত একান্ত আলাপে মির্জ্জা আজিজ এসব কথা বলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বরাদ্দ এবং বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামোগত আরও সুবিধা থাকা প্রয়োজন ছিল বলেও মত দেন তিনি।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করা গেছে। পরে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাও অর্জন করা যাবে না। ২০২১-২২ অর্থবছরের ক্ষেত্রেই একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ৬ দশমিক ২ শতাংশ ঘাটতি ধরা হয়েছে, যা বাংলাদেশের যেকোনো বাজেটের চেয়ে বেশি। তবে ঘাটতির এই লক্ষ্যমাত্রাকেও মির্জ্জা আজিজ গ্রহণযোগ্য মনে করছেন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ৬ দশমিক ২ মাত্রার ঘাটতি— এটা ঠিক আছে। আমার কাছে এটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজস্ব আহরণ। এই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা না গেলে বাস্তবে বাজেটে ঘাটতির মাত্রা আরও বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট প্রস্তাবনায় বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ৩২ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছেন। ব্যাংকিং খাত ও সঞ্চয়পত্রের ওপর সরকারের এই নির্ভরতাকে বিপজ্জনক মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, এমনিতেই ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অনেক কম। এ অবস্থায় সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ব্যাংকঋণ থেকে বঞ্চিত হবে। এতে দেশের বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
সঞ্চয়পত্রের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েছে। এবারও সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হবে। এটি লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণও হতে পারে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে— সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক ব্যয়বহুল। এতে সুদবাবদ অনেক অর্থ পরিশোধ করতে হয়। আর সরকার কখনো সুদ ডিফল্টার হতে পারে না। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যয় করতে পারে না। সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির অভিঘাতে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে এই বৈশ্বিক মহামারি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন সবাই। অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, এই বাজেট জীবন ও জীবিকার বাজেট। মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সব উদ্যোগই বাজেটে নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে মির্জ্জা আজিজ বলছেন, সাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে।
তিনি বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা খুব একটা বেশি না। এই খাতে আরও বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। তবে সেটিও যথেষ্ট নয়। আবার এখানে বরাদ্দ বাড়ালেও তার সুফল জনগণ পাবে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন। কারণ প্রায়ই দেখা যায়, ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ হলেও সেগুলো যাদের পাওয়ার কথা, তারা পায় না। নেতাদের গুদামে চাল পাওয়া যায়। সামাজিক সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ করা টাকার একটি বড় অংশই লুটপাট হয়ে যায়। এই লুটপাট বন্ধ করতে না পারলে যতই বরাদ্দ দেওয়া হোক, সেটি কোনো কাজে আসবে না।
করপোরেট কর কমানোসহ ব্যবসায়ীদের জন্য বেশকিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। ব্যবসায়ীরা এই বাজেটকে স্বাগতই জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এটি ব্যবসাবান্ধব বাজেট। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, এতে কর্মসংস্থান তৈরি হবে— অর্থমন্ত্রী এমনটিই বলছেন। তবে অর্থমন্ত্রীর এমন আশাবাদ কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বাজেটে কোম্পানির কর কমানো হয়েছে মূলত বিনিয়োগ বাড়াতে। অনেক দেশের তুলনায় আমাদের করপোরেট কর বেশি। তবে এটি কমানো হলেও বিনিয়োগ বাড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ বিনিয়োগরে জন্য অনান্য যে উপকরণ, বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং ইজ অব ডুয়িং বিজনেস— এসব ক্ষেত্রে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এসব ঘাটতি মেটানো সম্ভব না হলে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।
বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেন দুই অর্থবছরের বাজেট প্রণেতা মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা একই রয়েছে— তিন লাখ টাকা। এটা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কারণ তিন বছর আগের তিন লাখ টাকা আর আজকের তিন লাখ টাকার পরিমাণ এক না। মূল্যস্ফীতির কারণে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকায় উন্নীত করা উচিত ছিল।
অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এবারের এই বাজেট সম্প্রসারণমূলক বাজেট। একই কথা মনে করছেন মির্জ্জা আজিজও। এমন সম্প্রসারণশীল বাজেটে তিনি আপত্তি না দেখলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করছেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই বাজেটের বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের বেশিরভাগ বাজেট বাস্তবায়নের হার ৮০ শতাংশের মতো। তাই বাজেটের আকার বাড়লে বাস্তবায়নের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই বাজেট বাস্তবায়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাজেট বাজেট ২০২১-২২ বাজেট উত্থাাপন বাজেট স্পেশাল ২০২১-২২