চট্টগ্রাম ব্যুরো: সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বিদেশি গাছ লাগানোর পরিবর্তে দেশীয় ফলজ ও ঔষধি উদ্ভিদ রোপনের তাগিদ এসেছে চট্টগ্রামে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবসের’ এক ভার্চুয়াল সেমিনার থেকে। সড়ক-মহাসড়কের পাশে এবং বিভাজকে তিনস্তরে ঔষধি ও দেশীয় ফলজ গাছ লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছেন সেমিনারে অংশগ্রহণ নেওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।
শনিবার (৫ জুন) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো এই ভার্চুয়াল সেমিনারের আয়োজন করে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ঘোষণা অনুযায়ী ‘পরিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত এই সেমিনার সঞ্চালনা করেন ইকোর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম আবু ইউসুফ সোহেল।
‘রাস্তার পাশে বিদেশি সৌন্দর্যবর্ধক উদ্ভিদের পরিবর্তে দেশীয় ঔষধি উদ্ভিদ রোপন: সম্ভাবনা ও সুবিধা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইকোর সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল।
সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তা, উন্নয়ন কর্মী, সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ‘সড়কের পাশে ও বিভাজকে তিনস্তরের ঔষধি গাছ রোপন করা যায়। থানকুনি, বাসক ও আমলকি- এভাবে লাগানো যায়। চট্টগ্রাম শহরে যেসব গাছ লাগানো হয়েছে তার মধ্যে অনেক বিদেশি গাছ আছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়কের পাশে গাছ লাগায়, তাতেও বিদেশি গাছ দেখা যায়। মহাসড়কের পাশে এক সময় অর্জুন, বহেরা, হরিতকি ছিল। এখন আর দেখি না।’
‘ঔষধি গাছ থাকলে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারবে। বৃক্ষ রোপন, পরিবেশ রক্ষা ও কর্মসংস্থান সব হবে। শহরের খালি জায়গাগুলোতে ঔষধি গাছের বাগান করা যায়। এতে ছিন্নমূল মানুষের ফলের চাহিদা মিটবে। পুষ্টির ঘাটিত পূরণ হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় কাজে লাগবে। ওষুধের উপকরণ রফতানি এবং পরিবেশ সুরক্ষা হবে। বন্যপ্রাণী ও পাখির ফলের চাহিদা মিটবে। যদি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে গবেষণার কাজে লাগবে। দেশীয় প্রজাতি আমাদের ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে।’
সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহার কেমন, চাহিদা কতটুকু? মেডিসিনাল প্ল্যান্টের দেশীয় ও রফতানি চাহিদা কতটুকু? কেউ চাষের আগে জানতে চাইলে এ নিয়ে পরামর্শ আমরা দিতে পারি না। কারণ তথ্যের ঘাটতি। অনেকে জানতে চায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এসব তথ্য পাওয়া যায় না।’
সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘নগরী নিয়ে নগরবাসীর যে চাহিদা তা নগর পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত করা উচিত। বাস্তবায়নকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সামাজিক শক্তিগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। এজন্য একটা প্রক্রিয়া থাকা দরকার। গবেষণার কাজগুলো কেন বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে না তা খুঁজে বের করতে হবে। গবেষণালব্দ তথ্য আমাদের সঙ্গে আদান-প্রদান হলে এই জটিলতা নিরসন হবে। ফ্লাইওভার, সড়ক ও সড়ক বিভাজকে বৃক্ষরোপন করার চেষ্টা করছি। এসব গাছ কেমন হবে, সেগুলোর ভূমিকা কী হবে, তা জানতে হবে। আমাদের প্রকল্পে ছিল তাই হয়তো কিছু গাছ লাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আপনাদের গবেষণার ফল জানলে হয়তো আরও ভালো বৃক্ষরোপন করা যেত। আপনাদের সঙ্গে সমন্বয় ও জ্ঞানের আদান প্রদান চাই।’
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক বলেন, ‘১৬টি থানার মধ্যে চান্দগাঁও থানায় তিনটি অর্জুন গাছ আছে। কাকতালীয় কি না জানি না, সেই থানার একজনও করোনায় আক্রান্ত হননি। সড়কের পাশে আমরা যেসব গাছ লাগিয়েছি তার ৫ শতাংশও নেই। রক্ষা করা জরুরি। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের মাঝে লম্বা গাছ লাগানো হয়েছে। এতে গাড়ি চালকদের দৃষ্টি সীমায় সমস্যা হয়। সেখানে ছোট ও মাঝারি আকারের গাছ লাগানো উচিত ছিল। নগরীর চারটি ফ্লাইওভারের নিচে ঔষধি গাছ লাগানো জরুরি।’
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (স্থানীয় সরকার) বদিউল আলম বলেন, ‘দ্রুতগতিতে নগরায়ন ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ চলছে। সড়কের পাশে ও বিভাজকে ঔষধি গাছ লাগানো গেলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি নতুন প্রজন্ম দেশীয় গাছ সম্পর্কে জানতে পারবে। ঔষধি গাছ ব্যবহারের যে অভিজ্ঞতা তা কাজে লাগানো গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাও সহজ হবে। নগরীর ভিতরে সৌন্দর্য বর্ধনে এসব গাছের ব্যবহারের পরিকল্পনা করা উচিত।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিন্টু চাকমা বলেন, ‘রাস্তার ধার ঘেঁষে পৃথিবীর খুব কম দেশেই গাছ লাগানো হয়। একটু দূরত্ব রেখে লাগানো হয়। আমাদের রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে অল্প সময়ে অপরিপক্ক গাছ কেটে ফেলতে হয়। গাছের শিকড় রাস্তার স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। বন বিভাগ, সামাজিক বনায়ন প্রকল্প এবং আমরাও গাছ লাগাই। ঔষধি গাছ কিভাবে সড়কের স্থায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লাগানো যায় সেই প্রস্তাবনা পেলে ভালো হয়।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে ল্যান্ড সারফেস শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যা গাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেসব গাছ অর্থকরী নয় সেগুলো এখন আর লাগানো হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রামেও অনেক ভিতরের দিকে গেলে এসব ঔষধি গাছের খোঁজ পাওয়া যায়। অথচ চীনে জেনারেল হাসপাতালের পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের হাসপাতাল দেখেছি। আমাদের এখানে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ নেই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কলিমউল্লাহ বলেন, ‘লকডাউনে পরিবেশের অনেক সূচকের উন্নতি ঘটেছিল। আমরা নানারকম দূষণের মাধ্যমে প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের বিকাশ বাধাগ্রস্থ করছি। এর প্রভাব মানুষের জীবনেও পড়ছে। সবরকম দূষণ বন্ধ করতে এবং দেশীয় গাছে বনায়ন করতে হবে।’
সেমিনারে আরও অংশ নেন ইকোর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাহেদ মুরাদ সাকু এবং সংবাদকর্মী মিঠুন চৌধুরী।