ভাঙছে পাড়-বসতভিটা-ফসলি জমি, যমুনায় বিলীন স্বপ্ন
৬ জুন ২০২১ ১১:০৮
সিরাজগঞ্জ: বর্ষা আসতে এখনও কিছুদিন বাকি। শুরু হয়েছে বৃষ্টির মৌসুম। এতেই উজান থেকে নেমে আসা পানিতে যমুনা তার ভয়াল রূপ দেখাতে শুরু করেছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এরই মধ্যে জেলার শাহজাদপুর, চৌহালী ও এনায়েতপুরে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তিন শতাধিক বসতভিটা, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরবর্তী মানুষ তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
ভাঙন কবলিতদের অভিযোগ, বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নদীর ভাঙনরোধে কোনো কাজ শুরুই হয়নি এখনও। তবে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙন রোধে সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরেজমিন ভাঙন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আগেই রুদ্ররূপ ধারণ করেছে যমুনা। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। গত এক সপ্তাহে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের পাঁচিল ও হাট পাঁচিল, একই উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের পাকরতোলা ও এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগ্রামে তিন শতাধিক বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার ভাঙন কবলিতরা সহায়-সম্বল হারিয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙে রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারের নারী-শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা।
এদিকে যমুনা নদীর পানির তীব্র ঘূর্ণাবর্তের কারণে চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের হাটাইল, ঘুশুরিয়া, হিজুলিয়া, কাঠালিয়া ও উমারপুর ইউনিয়নের পয়লার প্রায় তিন কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকায়ও ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই এই এলাকাগুলোর বিস্তীর্ণ ফসলি জমিসহ হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে এই এলাকাগুলোর নদীতীরবর্তী হিজুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম সম্ভুদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাস মধ্য শিশুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিশ্রিগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারবয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসুফ শাহি সলঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলজলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাউশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শৈলজানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাটাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ভাঙনকবলিত স্থানীয়দের অভিযোগ, এনায়েতপুরের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকা বরাবরই অরক্ষিত। প্রতিবছরেই এই এলাকাগুলোতে দেখা দেয় নদীভাঙন, নিঃস্ব হয় মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যথারীতি ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এসে বারবার নদী ভাঙন বন্ধে দ্রুত কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। ফলে বছরের পর বছর নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ফসলি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক ধনাঢ্য মানুষ।
নদী ভাঙন কবলিত কৈজুরি ইউনিয়নের পাঁচিল গ্রামের কালাম ফকির সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৈত্রিক সূত্রে ১১ বিঘা ফসলি জমি ও তিন বিঘার একটি বসতবাড়ি পেয়েছিলাম। বাড়িতে অন্তত ১৫টি দুধেল গাভি ছিল। গত কয়েকবছর ধরে ভাঙনে সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত ২৯ মে আমার শেষ সম্বল ৪০ কাঠার ফসলি জমি আর বসতভিটা একসঙ্গে ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে। ঘড়বাড়ি ভেঙে সরিয়ে রাস্তার ঢালে রেখেছি, নিঃস্ব হয়ে পথে নেমে গেলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন বছর আগে আমার জমি যখন ভাঙা শুরু হয়, তখন থেকেই শুনছি নদীতে বাঁধ দেওয়া হবে। কিন্তু আজও কোনো কাজ শুরু হলো না। অথচ আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবুল সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী এসে বলে গেল এই এলাকার আর এক চাপ জমিও নদীতে যেতে দেওয়া হবে না। অতিদ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। অথচ গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক বসতভিটা ও কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন বন্ধে কোনো কাজ শুরুতো দূরের কথা, কেউ খোঁজও নিতে আসেনি।’
জালালপুরের পাকরতোলা গ্রামের চায়না বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ছিল কৈজুরির পাঁচিলে। ভাঙনে আমাদের বসতভিটা নদীতে চলে যাওয়ায় পাকরতোল এসে এক আত্মীয়ের জমিতে ঘর তুলেছি। এখন এই বাড়িও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। দুবছর আগেও গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান ছিল। এখন আমরা নিঃস্ব। সরকার কোনো সহযোগিতা না করলে আমাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।’
স্থানীয় কবির হোসেন ও হাসানুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, পাঁচিল, হাট-পাঁচিলে যেভাবে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে গত এক সপ্তাহে তিনশতাধিক বসত ভিটা ও অনেক ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। কিন্তু এখনও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো তৎপরতা নেই। দ্রুত এই ভাঙন থামাতে কাজ শুরু করা না হলে অল্প সময়েই হয়তো আরও কয়েকটি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনায়েতপুর থেকে কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার অরক্ষিত নদীতীর রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুতই অনুমোদন হবে বলে আশা করছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই এলাকায় আর ভাঙন থাকবে না।’
এই নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার মহোদয়ের পরামর্শক্রমে ভাঙন রোধে জরুরিভিত্তিতে চর কেটে নদীর স্রোত পরিবর্তনের জন্য ২৬ ইঞ্চি একটি ড্রেজার আনা হচ্ছে। ড্রেজারটি পৌঁছলে দ্রুত চর কেটে দেওয়া হবে। এতে ভাঙন কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
সারাবাংলা/পিটিএম