মাতুয়াইলের ভাগাড়ে ক্ষতিকর মিথেন: উৎস খুঁজছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়
৭ জুন ২০২১ ১২:৩০
ঢাকা: জীবন আছে এমন জিনিস পঁচে গিয়ে উৎপন্ন হয় মিথেন গ্যাস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মিথেন কার্বনডাইঅক্সাইডের মতো না হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এটি অনেক বেশি ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতিকর গ্যাস পৃথিবীর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে নাকি ঢাকার মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড় থেকে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে এমন তথ্য দিয়েছে নিঃসরণ ট্র্যাকিং সংস্থা জিএইচজিস্যাট ইনক। আর এই তথ্য আমলে নিয়ে মিথেন গ্যাসের উৎস খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ জন্য গত ২৪ এপ্রিল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (জলবায়ু পরিবতর্ন-১) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছি। কমিটি ময়লার ভাগাড় পরীক্ষা করে দেখবে আসলেই মিথেন গ্যাস নির্গমন হচ্ছে কি না; মিথেনের মাধ্যমে জীবন ও পরিবেশের ক্ষতির বাইরে আরও কোনো বিষয় আছে কি না। জিএইচজিস্যাট তাদের প্রতিবেদনে বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিথেন ঢাকা থেকে নির্গমন হয়। সেটা আমরা দেখব। আমরা প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা কাজ করছে।’
ঢাকা শহরে উচ্চমাত্রার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতির খবর প্রথম প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ। যাদের সংবাদের উৎস ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান। ব্লুমবার্গ ওই প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে যেসব দেশ রয়েছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা তথ্যানুযায়ী, মাতুয়াইল থেকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় চার হাজার গ্রাম মিথেন নির্গমন হচ্ছে। যা এক লাখ ৯০ হাজার প্রচলিত গাড়ি চালালে যে উষ্ণায়ন হয় তার সমান এবং কার্বনডাইঅক্সাইডের চেয়ে ৮৪ গুণ শক্তিশালী। আর এই নির্মগন গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের প্রধান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. মমিনুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। যখন মিথেন গ্যাস বাংলাদেশের আকাশে দেখা গেছে তখনকার এবং তার আগে ও পরের এই তিন ধরনের তথ্য ও ছবি চাওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে যে সূর্যের আলো পড়ে তা আবার উঠে যায়। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বাতাসে যদি মাত্রারিক্ত মিথেন মিশে যায় তবে আবরন তৈরি করে। এতে যে আলোটা আসে তা আর যথাযথভাবে ফেরত যায় না। অনেকটা কম্বলে ঢেকে দেওয়ার মতো। তাপ আর উপরে উঠে যেতে পারে না। সেজন্য পরিবেশ উত্তপ্ত থাকে। বেশি গরম অনুভব হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন কিছু আছে কি না তা আমরা খুঁজে দেখব। ব্লুমবার্গ ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথ্য জমা করেছে। স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে বোঝা যাবে না যে ঢাকার এই জায়গা থেকেই মিথেন নির্গমন হচ্ছে। বলারও সুযোগ নেই। সরাসরি পরীক্ষা করা আর ইমেজ দেখে বলা দুটো দুই জিনিস। তবে আবহাওয়ার গতিবিধি নির্ণয় করে বলে দেওয়া যায়। তবে আমাদের কাছে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য নেই। একটি রিপোর্ট, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং বায়ুমণ্ডলের লেভেল অনুসারে এগুলো ভ্যারি করে। ওই সময়ে বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতি কি ছিল, সেটা যদি আবহাওয়া অধিদফতর সংগ্রহ করতে পারে তাহলে ওই প্রতিবেদনের সত্যতা বোঝা যাবে। সেজন্যই আমরা তথ্য চেয়েছি। এরপর আমরা সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব, কোথা থেকে মিথেন নির্গমন হচ্ছে।’
জানা গেছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কমিটিকে এক মাস সময় দিয়েছিল। গত ২৪ এপ্রিল কমিটি গঠন করা হয়। গত ২৪ মে এক মাস পার হয়েছে। কিন্তু একটা বৈঠক ছাড়া এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করতে পারেনি কমিটি। কমিটির সদস্য সচিব পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (জলবায়ু পরিবর্তন -৩) ধরিত্রী কুমার সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছি। সবগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে এখনও সদস্য দেওয়া হয়নি। তাছাড়া করোনার কারণেও একটু দেরি হচ্ছে। তাছাড়া বিষয়টি জটিল। এত কম সময়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘মিথেন গ্যাস নির্গমনের যে স্থানের কথা বিদেশি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে আমরা সেটা চিহ্নিত করব। তারপর আমরা পরীক্ষা করে দেখব সেখানে বিন্দুমাত্র মিথেনের উপস্থিতি আছে কি না। তবে এর জন্য অনেক কাজ করতে হবে। এ কাজে সময় প্রয়োজন। আমরা আপাতত আরও এক মাস সময় চেয়েছি।’
সূত্র জানায়, রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় ১৮১ একর জমিতে ময়লার ভাগারটি অবস্থিত। দিনে এখানে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য ফেলা হয়। যা এরই মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পরার অবস্থায় রয়েছে।’
গ্লোবাল মিথেন ইনিশিয়েটিভের তথ্যানুযায়ী তেল, গ্যাস ও শিল্প থেকেও মিথেন নিঃসরণ হয়। এছাড়া গৃহপালিত পশু, ধান চাষ মিথেন নির্গমনের ছোট ছোট উৎস। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি উপগ্রহের উপাত্ত বিশ্লেষণকারী কায়রোসের মতে, মেঘের আচ্ছাদন, বৃষ্টিপাত এবং বিভিন্ন আলোর তীব্রতার কারণে মহাকাশ থেকে মিথেনের পর্যবেক্ষণে সমস্যা হতে পারে। বিশ্লেষক সংস্থা কায়রোস এসএএস জানিয়েছে, স্যাটেলাইটের তথ্যে এই বছর সবচেয়ে বেশি মিথেন নিঃসরণ ধরা পড়েছে বাংলাদেশে। যার পরিমাণ ১২ শতাংশ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বায়ুমণ্ডলে দূষণ কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ু দূষণ ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ আর ২০৪০ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৬ শতাংশ কমানো হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ডেনমার্কের সহায়তায় রাজধানীতে গ্যাসের ছিদ্র পাইপলাইন পরিবর্তনের কাজ চলছে। এটা শেষ হলে বাতাসে মিথেন মিশে যাওয়ার পরিমাণ কমবে বলে আশা করা যায়।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম