Tuesday 01 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আলাদা মন্ত্রণালয়ের দাবি

সারাবাংলা ডেস্ক
৮ জুন ২০২১ ২২:৫৯ | আপডেট: ৯ জুন ২০২১ ১০:৩৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমুদ্র তীরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় রয়েছে সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা। বিশ্ব সমুদ্র দিবস উপলক্ষে সাগরের এই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও জীবিকার লক্ষ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনায় দেশে আলাদা একটি সমুদ্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার (৮ জুন) বিশ্ব সমুদ্র দিবস উপলক্ষ্যে সমুদ্র পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন সেভ আওয়ার সি আয়োজিত এক ওয়েবিনারে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন সমুদ্রবিজ্ঞানী এবং গবেষকরা। একই সঙ্গে সমুদ্র দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানান তারা। একইসঙ্গে দূষণে জড়িতদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা গেলে দূষণ কমে যাবে বলেও মত প্রকাশ করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

‘জীবন ও জীবিকা’- প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব সমুদ্র দিবস। আলাদা মন্ত্রণালয় করে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলো সাগর অর্থনীতি থেকে বিলিয়ন ডলার অর্জন করা সম্ভব বলে জানানো হয়।

সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দিন। প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী জাভেদ আহমেদ, ওয়ার্ল্ড কনসারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জাহাঙ্গীর আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক বিশ্বজিৎ নাথ, পিএইচডি, ব্লু ইকনোমি বিশেষজ্ঞ ড. দিলরুবা চৌধুরী, বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফি রিচার্স ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টেফিক অফিসার মোহাম্মদ জাকারিয়া, সমুদ্র বিশেষজ্ঞ এবং সেভ আওয়ার সির ডিরেক্টর এসএম আতিকুর রহমান, পেপার কাপ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান কেপিসি ইন্ডাস্ট্রির স্বত্তাধিকারী সাজেদুর রহমান এবং মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদ সোহেল প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘পৃথিবীর জন্য সাগর অর্থনীতি এক বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। উন্নত রাষ্ট্র এই খাতকে কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। সেখানে বাংলাদেশ এই সম্পদ আহরণের জন্য একটি স্বাধীন মন্ত্রণালয় গঠন করতে পারেনি গত ৯ বছরে। যা হতাশাজনক। এবারের বাজেটে সাগর অর্থনীতি নিয়ে আলাদা বরাদ্দ রাখা সময়ের দাবি ছিল। সেটাও হয়নি। আজ হোক, কাল হোক সাগর অর্থনীতি হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ এটি বুঝতে পারবে তত দ্রুত টেকসই এবং উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছাবে দেশ।’

আয়োজনে বক্তারা বলেন, ‘পৃথিবী কতদিন টিকে থাকবে সে ধারণা পাওয়া যাবে সমুদ্রের দিকে তাকালে। সমুদ্রতলে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র একটি উদ্ভিদ ফাইটোপ্ল্যাংটন থেকে আসে পৃথিবীর অর্ধেক অক্সিজেন। সমুদ্র থেকে পাচ্ছি সি উইড, ওষুধ ইত্যাদি নানাকিছু। সমুদ্র ৯০ ভাগ তাপমাত্রা শোষণ করে নেয়। তাই সমুদ্র শোষণক্ষমতা হারিয়ে ফেললে পৃথিবীর অবস্থা হবে ভয়াবহ। অথচ আমরা একে ডাম্পিং প্লেস বানিয়ে ফেলেছি যা বায়োডাইভার্সিটি নষ্ট করছে।’

‘বাংলাদেশে খাদ্য, ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনধারনের সব কিছুরই প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ কারণে আমাদের যেতে হবে সমুদ্রের দিকে। বঙ্গোপসাগর ছাড়া আমাদের আর কোনো বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশি নেই। যদি একে বন্ধু বানাতে পারি, তাহলে আমরা বাঁচতে পারবো।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘যারা সমুদ্র দূষণের সঙ্গে জড়িত, তাদের থেকেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা গেলে ধীরে ধীরে দূষণ কমে আসবে এবং জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু সমুদ্রসীমা অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। সমুদ্রকে কত উপায়ে আমরা কাজে লাগাতে পারি তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। বিশেষ করে সাগরের ইকোসিস্টেম ঠিক রাখা এবং এখানকার সম্পদ আরোহণের বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা উদঘাটন করতে হবে।’

‘আমরা অনেকগুলো ইকোসিস্টেম নিয়ে কথা বললেও মেরিন ইকোসিস্টেম নিয়ে কথা বলি না। মেরিন ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একটু একটু করে এসব আলোচনায় উঠে আসছে। এখন এক নম্বর ইস্যু হতে হবে যত বেশি সম্ভব গবেষনা করে ডাটা সংগ্রহে। প্রয়োজনে একাজে নৌ-বাহিনীর সযোগিতা নিতে হবে। এখনও সময় আছে আমাদের এ নিয়ে কাজ করতে হবে। এ বছর না হলে আগামী বছরও যেন বাজেট থাকে, সে চেষ্টা করতে হবে।’

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নিবার্হী অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেন, সাগরের ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে কিভাবে পর্যটন খাতকে লাভজনক করা যায় তা নিয়ে সরকার একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে। গবেষকরা বলছেন, দূষণমুক্ত রাখতে হবে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। চট্টগ্রাম থেকে বড়বড় জাহাজ যাচ্ছে সেন্টমার্টিনে। এগুলোর কারণে উপকার হচ্ছে নাকি ক্ষতি হচ্ছে এগুলোও গবেষণা করা দরকার।’

আলাদা মন্ত্রণালয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি উঠছে। এটা হতে পারে। তবে এখন ১৯টা মন্ত্রণালয় সুনীল অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্লু ইকনোমি সেল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেখান থেকেই কাজ হচ্ছে। মূলতঃ ব্লু ইকনোমি নিয়ে সরকারের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারও জানে অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতে। একই সঙ্গে পর্যটন শিল্প নিয়েও আমাদের চিন্তা রয়েছে। পর্যটন যেহেতু শ্রমিনঘনিষ্ঠ একটি সেক্টর। এখানে অনেক মানুষ জড়িত। এটা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।’

ওয়ার্ল্ড কনসারভেশন সোসাইটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রতিবছর পৃথিবীতে ১৫ কোটি টন প্লাস্টিক তৈরি হয় যা একবার মাত্র ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এর ৮৩ টন সাগরে এসে জমা হয়। প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মেরিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা জরুরি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিশ্বজিত নাথ বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা গত এক বছরে ১.৫ ডিগ্রি বেড়েছে। সমুদ্র বেশি উত্তাল হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে যখন বায়েলোজিক্যাল সীমা অতিক্রম করে, তখন ডিজাস্টার তৈরি হচ্ছে। আমাদের এখই পদক্ষেপ নিতে হবে। ল্যান্ড থেকে যেন কোনো বর্জ্য বা প্লাস্টিক সমুদ্রে যেতে না পারে তার জন্য বর্জ্য রিসাইক্লিং নিয়ে ভাবতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাপক পরিমাণে বনায়ন করতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আশপাশের সব দেশ মিলেই এসব করতে হবে।’

বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফি রিচার্স ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এমডি জাকারিয়া বলেন, ‘সমুদ্র থেকে আমরা যে সার্ভিসটা পাই, এটাকে কন্টিনিউ করতে হলে সমুদ্রের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু মাছ ছাড়া সমুদ্রে আর কি কি সম্পদ আছে, তা আমরা কোনোভাবেই আমরা তুলে ধরতে পারিনি। সমুদ্রের ইকনোমি অ্যাপ্লিকেশন কি কি হতে পারে, আমরা এখনও তা সরকারকে বোঝাতে পারিনি। এটি বোঝাতে পারলে দ্রুত কাজ হতে পারে।’

ব্লু ইকনোমি এক্সপার্ট, ভার্চুসো রিচার্স অ্যান্ড কনসালটেন্সি ফার্মের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক দিলরুবা চৌধুরী বলেন, ‘সবার আগে সমুদ্র দূষণ দূর করতে হবে। সেন্টমার্টিনে যেতে দেখা যায় এখনও অবাধে প্লাস্টিক এবং চিফসের প্যাকেট ফেলা হচ্ছে পানিতে। ২০০২ সালে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। একই সঙ্গে ওভার ফিশিংয়ের কারণে সমুদ্রের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গোস্ট নেটের কারণে সমুদ্রের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা কল্পনারও বাইরে। বিশেষজ্ঞরা হয়তো জানে; কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে না। অনেক বেশি যানবাহন নদী এবং সমুদ্রের পানিতে চলছে যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। প্রতিটি দেশেই নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুই নেই’।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুখলেসুর রহমান বলেন, ‘সমুদ্র্রের একটু অংশের মালিক হওয়ার কারণে আমরা ভাগ্যবান জাতি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ওশেনোগ্রাফি ইনস্টিটিউটকে সমুদ্রে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। আলাদা করে নৌ-বাহিনীর অনুমোদন লাগে। দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে সঠিক তথ্য উঠে আসছে না। ফলে সমুদ্রকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না?’

ওশেন এক্সপ্লোরার এসএম আতিকুর রহমান বলেন, ‘পানিতে ভাসতে থাকা সমুদ্রের জীব-প্রাণ প্লাস্টিক খেয়ে খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কোরাল নষ্ট হচ্ছে। পুরো সাগরজুড়ে গোস্টনেট ছাড়াও প্রচুর পরিমাণ জাহাজের বড় বড় রশি ও খালি বোতল পাওয়া গেছে। এছাড়াও উপকুলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে ম্যানগ্রোভ বন ও পাখির অভয়ারন্য নষ্ট হচ্ছে। প্লাস্টিকের কারণে সমুদ্রতলের প্ল্যাংকটন ধ্বংস হচ্ছে। প্ল্যাংকটন ধ্বংস হলে অক্সিজেন আসবে না। ফিল্টার ফিডার নষ্ট হলে সূর্যের রশ্মি কাজ করবে না। এভাবে আমাদের সমুদ্র ভালো থাকবে না। পৃথিবীও ভালো থাকবে না।’

মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদ সোহেল বলেন, ‘এবারের বাজেটে সমুদ্র বা সুনীল অর্থনীতি কোনো কিছু না থাকার কারণে আমরা সবাই হতাশ। সমুদ্র নিয়ে রাষ্ট্রীয় মনোভাব আমাদের কাছে পরিষ্কার না। সমুদ্রসীমা জয়ের পরপরই তো এ নিয়ে একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা উচিৎ ছিল। অথচ ৬-৭ বছর পার হয়ে গেলো, আমরা কিছুই চোখে দেখছি না।’

গ্রিন ইনিশিয়েটিভ বিজনেসের সাজেদুর রহমান বলেন, ‘আমরা পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করি। টেকনোলজি কঠিন হলেও আমরা এসব বাজারজাতের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য এখনও পরিচিতি পায়নি। পরিচিতি পেলে, জনপ্রিয় হলে প্লাস্টিকের দূষণ কমে যেতো।’

একইসঙ্গে ট্যুরিজম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় ক্ষতি ঠেকানো যাবে না বলেও দাবি করেন তারা। তারা বলেন, সমুদ্র পরিবেশ ঠিক রাখতে সরকার যে পরিমাণ বরাদ্দ দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি নষ্ট হচ্ছে ট্যুরিজমের কারণে। ।

সারাবাংলা/আরএফ/

ব্লু ইকোনমি সমুদ্র দিবস সুনীল অর্থনীতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর