করোনাকালেও সরকার প্রথাগত বাজেট থেকে বের হতে পারেনি
৮ জুন ২০২১ ২৩:০২
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারির এই সংকটকালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ভিন্ন ধরনের বাজেটের প্রয়োজন থাকলেও ২০২১-২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটটি গতানুগতিক বাজেটের মতোই হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। এমনকি অর্থমন্ত্রী নিজেও বাজেটের যে শিরোনাম দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাজেট সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেও মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক এই চেয়ারম্যান।
ড. আব্দুল মজিদ বলেন, এবারের বাজেটটিও অতীতের অন্য সব বাজেটের মতোই হয়েছে। বাজেটের শিরোনামের সঙ্গে সম্পদ বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি করোনাকালের বাজেট, একটি জটিল সময়ের বাজেট, জরুরি সময়ের বাজেট। সরকারও পরিস্থিতি বিবেচনায় সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার প্রথাগত বাজেট থেকে বের হতে পারেনি।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাবিত ২০২১-২১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে মঙ্গলবার (৮ জুন) সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপে এমন মন্তব্য করেন ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। করোনায় জীবিকা হারানো ও প্রবাস ফেরত নাগরিকদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ বাজেটে না থাকার সমালোচনা করেন তিনি। একইসঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানান।
এই বাজেটকে কেন প্রথাগত বাজেট বলছেন— সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, যারা সম্পদ বিভাজন করেন, খাতওয়ারি অর্থ বরাদ্দ দেন, যে পদ্ধতিতে বরাদ্দ দেন, যেভাবে বাজেট সংসেদে পেশ ও পাশ করা হয়— এসব পদ্ধতিতে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা থাকে, কিছু প্রথা থাকে। প্রথাগত বাজেট বলার অর্থ হলো, এবারও সেসব সীমাবদ্ধতা থেকে বাজেটকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি, যদিও এবার প্রথাগত বাজেট থেকে বের হয়ে আসার খুবই প্রয়োজন ছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
আরও পড়ুন-
- প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকার বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে
- বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া
- রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব নয়, বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ
বাজেট শিরোনামের সঙ্গে এর পরিকল্পনা ও বিন্যাসের পার্থক্য তুলে ধরে ড. আব্দুল মজিদ বলেন, প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটকে জীবন-জীবিকার বাজেট বলা হচ্ছে। কিন্তু জীবন-জীবিকার বাজেট বলতে যেটি বুঝায়, সেটি হলো আগে আমাদের মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে। জীবন বাঁচানোর পর তাদের জীবিকার সন্ধান দিতে হবে। জীবিকার সন্ধান দিলে অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিকভাবেই সচল হবে। অর্থনীতি সচল হলে বাকি সব হবে। এটি অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদি একটি কার্যক্রম। বাজেটে এই স্বল্পমেয়োদি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বক্তব্য যতটা এসেছে, বাস্তবে প্রয়োগের জায়গাটিতে ততটা আসেনি।
তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়ে যে সমস্যাটা সব সময় ছিল, সেটি দূর করার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিজ্ঞা, বক্তব্য বা স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রয়োজন ছিল। সেটি আসেনি। জীবিকা বাঁচানোর জন্য যে দৃঢ় সংকল্প এই সময়ে থাকা দরকার ছিল, সেটি প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। ফলে বাজেট তার প্রথাগত অবস্থান থেকে বের হতে পারেনি। শিরোনামেই সময়ের কিছুটা প্রতিফলন ছিল, বাজেটে নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত সব কোম্পানির জন্যই। একক ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির জন্য কর কমানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীদের জন্য আরও কিছু সুবিধাও রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও এই বাজেটকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাজেটের এই উদ্যোগগুলো দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন এনবিআরের সাবেক এই চেয়ারম্যান। এগুলোকে ইতিবাচক বলছেন তিনিও। তবে শিরোনাম ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে হলে স্বল্প মেয়াদি কিছু পরিকল্পনা বাজেটে থাকা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন তিনি।
ড. আব্দুল মজিদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন— বাজেটে করের হার কমানো হয়েছে, বেশকিছু ক্ষেত্রে কর অবকাশ ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোর অর্থ— কর কমানোর কারণে এখানে বিনিয়োগ হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্সংস্থান তৈরি হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে তা ঠিক আছে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা থাকলে সেটি বাজেট শিরোনামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ সচিব বলেছেন, করপোরেট কমানো ও ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ হলেই কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ফলে করোনায় যারা কাজ হারিয়েছেন, তাদের অনেকেই কাজ ফিরে পাবেন এবং সেটি খুব শিগগিরিই পাবেন। মন্ত্রী ও সচিবের এমন বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন ড. আব্দুল মজিব।
তিনি বলেন, বাজেটটি দেওয়া হয়েছে দূরবর্তী পরিকল্পনা করে। অর্থাৎ ১০ বছর ব্যবসা করবেন, ব্যবসা করলে কর অবকাশ সুবিধা দেবো, কর অবকাশ সুবিধা পেলে দেশে বিনিয়োগ হবে, বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হবে— এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এতে সময় ও পরিবেশ লাগবে। করপোরেট কর কমালেই বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য একবছরের মধ্যে গতিশীল হবে— এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ব্যবসার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে করোনায় কাজ হারানো ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবলে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন ছিল।
এ ক্ষেত্রে গত বছর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের উদাহরণ তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, প্রণোদনার উদ্দেশ্যে ছিল করোনাকালীন সংকট উত্তরণে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করা। কিন্তু বড় বড় ব্যবসায়ীরা প্রণোদনা নিলেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তারাও কিন্তু তেমন কিছু করতে পারেননি। আবার এসএমই খাতে প্রণোদনার টাকা ঠিকমতো পৌঁছানোই সম্ভব হয়নি। তাই প্রণোদনা তেমন কাজে আসেনি। এবারেও ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটি ভালো হয়েছে। কিন্তু এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখনই তারা অনেক কিছু করে ফেলবেন, তেমনটি ভাবার কারণ নেই।
বাজেটে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল— এমন মত দিয়েছেন অনেকেই। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ড. আব্দুল মজিদ বলেন, বরাদ্দ দেওয়াটা হলো সংখ্যার বিষয়, অঙ্কের বিষয়। আসল কথা হলো বাজেট বাস্তবায়ন কিভাবে হবে। বাস্তবায়ন করাটা যাবে কি না, সেটি প্রশ্ন। অতীতের বরাদ্দ দেওয়া অর্থ কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি— এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আগের বাজেটই যেখানে বাস্তবায়ন করা যায়নি, সেখানে এরকম বাস্তবায়ন না করা গেলে নতুন করে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে কী লাভ? তাই বরাদ্দ নয়, বাজেট বাস্তবায়নের প্রতি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
বরাদ্দের অঙ্ক নিয়ে না ভেবে বরং স্বল্পমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত থাকার বিষয়টিতেই বারবার জোর দিচ্ছেন ড. আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, বাজেটে জীবন ও জীবিকার জন্য একেবারে কিছু করা হয়নি, তা বলব না। তবে স্বল্পমেয়াদি তেমন কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে করোনায় যারা চাকরি হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন কিংবা নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছেন— প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। আবার যারা বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে এসেছেন, তাদের জন্যও কিছু করা দরকার ছিল। এই সময়ে তাদের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো কোনো প্রকল্প নেওয়া যেত। সেটি বেশি কাজের হতো।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ প্রস্তাবিত বাজেট বাজেট বাজেট ২০২১-২২ বাজেট বিশ্লেষণ