হাওরের শিক্ষা: পড়ালেহায় বাচ্চাদের কিছুডা মন বইছে
১০ জুন ২০২১ ২০:২৬
বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু-শিক্ষার্থী আব্দুন নূরকে প্রশ্ন করা হলো, বলো তো শুনি, ‘শীতের সকালে রোদ …. লাগে।’ খালি জায়গায় কী শব্দ বসালে বাক্যটি সঠিকভাবে তৈরি হবে?
প্রত্যুত্তরে দীর্ঘ শ্বাস টেনে শিশু-শিক্ষার্থী নূর বলল, শীতের সকালে রোদ ‘মিষ্টি’ লাগে স্যার!
বাহ্! বলে উৎসাহিত করে আবার প্রশ্ন করা হলো, বলো তো ‘অতিথি এলে… দেব।’ বাক্যটি তৈরিতে খালি জায়গায় কোন শব্দ বসাতে হবে? এবার আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর দিল, অতিথি এলে ‘নাশতা’ দেব স্যার!
এভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ থেকে কয়েকটি প্রশ্নের সাবলীলভাবে সঠিক উত্তর দেওয়ায় ‘সাবাস’ প্রশংসাসূচক শব্দ শুনে শিশু-শিক্ষার্থী নূর হুর রে জয়ধ্বনিতে দেয় ভোঁ-দৌড়।
একইভাবে পঞ্চম শ্রেণির জিসা ও সোহান, প্রথম শ্রেণির মেহজাবিন, দ্বিতীয় শ্রেণির মিশেল, চতুর্থ শ্রেণির ফাহমিদা হাসান মুন ও সাইমন, তৃতীয় শ্রেণির মীর জান্নাতুল ইসলাম মিশেল, মুশফিকুর রহমান অভিক, জাহিদুল করিম ভূঁইয়া ও নাফিউল ইসলাম ভূঁইয়া নিলয়সহ প্রথম শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণির শিশু-শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ন্যাপ কর্তৃক প্রণীত বাড়িরকাজ বা ওয়ার্কশিট বুঝিয়ে দেওয়া হলে অভিভাবকরাও অনুপ্রাণিত হন।
গত সোমবার (৭ জুন) কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদ উল্লাহ্ এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মতিউর রহমান গোপদিঘী ইউনিয়নের বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে এসে ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে শিশু-শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তেরের ভূয়সী প্রশংসা করেন। শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক মো. আবু জাহের মীর, মোছাম্মদ মদিনা খাতুন, মাহবুব আলম ও মো. মাহবুব করিম ভূঁইয়াসহ অন্যদের সাধুবাদ জানান।
এর আগে, একইভাবে হাসানপুর, শাইলদিঘা, খাসাপুর ও শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত ছাত্রছাত্রীদের ক্যাচমেন্ট এরিয়া পরিদর্শনে ওয়ার্কশিট বিতরণ কার্যক্রমেও অংশ নেন তারা।
সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় জানায়, ন্যাপ কর্তৃক প্রণীত লেসন প্ল্যান অনুযায়ী ইটনায় ৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১২টি কেজি স্কুলের প্রায় ৩০ হাজার, মিঠামইনে ৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৭ হাজার ৪শ ১৪ জন ও অষ্টগ্রামে ৮৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২২ হাজার ৪শ ১৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে চতুর্থ ধাপের ওয়ার্কশিট বিতরণের কার্যক্রম চলছে। এর আগে আরও তিনটি ধাপের ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইটনা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকিকুর রেজা খাঁন, মিঠামইনের মো. শহীদ উল্লাহ্ ও অষ্টগ্রামের আশরাফুল আলম জানান, বিশ্ব মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে গতবারের ১৭ মার্চ থেকে বিদ্যালয়ের শিশু-শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যে ঘাটতি হয়েছে। সরকার তা পুষিয়ে নিতে চিন্তাভাবনা করে এরইমধ্যে গ্লোবাল গাইড প্রণয়নসহ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জুম মিটিং সম্পর্কে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা এবং শিশু-শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ক্লাস নেওয়া।
জিপিএস ম্যাপের আওতায় হাওর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা বিভিন্ন ক্লাসটারে শিক্ষকেরা গুগল মিটের মাধ্যমে প্রতিদিন শ্রেণি পাঠদান করায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলেও জানান।
তারা জানান, শিক্ষাকে চলমান রাখতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সর্বশেষ অংশ হিসেবে হাতে-কলমে শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাড়িরকাজ বা ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে চলমান রাখার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে এখন চলছে ওয়ার্কশিট বিতরণের চতুর্থ ধাপের কাজ। বিদ্যালয় না খোলা পর্যন্ত এ ধাপ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে বলেও জানান তারা।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের জ্যেষ্ঠ-পুত্র কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের তিনবারের নির্বাচিত এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনায় ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়নের কাজে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি তা নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গিয়ে বাড়ির কাজ বা ওয়ার্কশিট বিতরণ ও খোঁজখবর নেওয়ায় শিশু-শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকেরাও বেশ উৎসাহবোধ করছেন।
শিশু-শিক্ষার্থীর অভিভাবক জেসমিন আক্তার, নিগার সুলতানা বন্যা, নাদিয়া আক্তার, খাদিজা খাতুন, পায়েসা আক্তার, কামরুন্নাহার, নাহিদা আক্তার ও মো. আইনুলদের অভিব্যক্তি এরকম। করোনার মইধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাইমমত বছরের পয়লাতেই নয়া বই দিয়া এবং শিক্ষকদেরও বাড়িতে বাড়িতে পাঠাইয়া বাচ্চাদের বাড়িরকাজ দিয়ে আদায় করায় কিছুডা অইলেও পড়ালেহায় মনডা বইছে।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর একটি বুলেটিনে দেখা গেছে, ৭১টি দেশে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত দিলেও বিশ্বের অন্তত ১২৮টি দেশ এখনও স্কুল খোলার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। তাতে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে সারাদেশে ২ কোটি ৯ লাখ ১৯ হাজার ২শ’ একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
সারাবাংলা/একে