ভ্যাকসিন সক্ষমতা নিশ্চিত করতে চতুর্মুখী কূটনৈতিক তৎপরতা
১০ জুন ২০২১ ২২:৫৯
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শতভাগ ভ্যাকসিন সক্ষমতা নিশ্চিতে চতুর্মুখী তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। আর এই তৎপরতার আওতায় কেবল ভ্যাকসিন কেনা বা সংগ্রহ করা নয়, দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের দিকেও মনোযোগী সরকার। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, সব ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের ঘোষণা আসতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের জন্য একমুখী যোগাযোগ চালালেও এবারে আর সে পথে হাঁটছে না। ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে— সম্ভাব্য এমন সব জায়গাতেই এখন যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ।
সূত্রগুলো বলছে, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই চীন থেকে উপহারের দ্বিতীয় দফার ৬ লাখ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন আসার কথা রয়েছে। এর সঙ্গেই চীনের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কার হবে এই সময়ে। একই সময়ে রাশিয়া থেকে ৫০ লাখ স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন আনার সম্ভাব্য দিন-তারিখও চূড়ান্ত হতে পারে।
ভ্যাকসিন সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হলে ভ্যাকসিন সংগ্রহের পাশাপাশি উৎপাদনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে এবারে ভ্যাকসিন উৎপাদনেও বাংলাদেশ জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্র। জানা গেছে, যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে বাংলাদেশ একইসঙ্গে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ধারাবাহিক আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে আলোচনায় খানিকটা ছন্দপতন ঘটেছে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ক্রয়মূল্য প্রকাশ হয়ে পড়া ইস্যুতে। চীনের এই ভ্যাকসিন শ্রীলঙ্কা ১৪ ডলার ও ইন্দোনেশিয়া ১৭ ডলারে কিনলেও বাংলাদেশ কৌশলী হয়ে ১০ ডলারে কিনতে পেরেছিল। এই দাম গোপন রাখার শর্ত থাকলেও তা প্রকাশ হয়ে পড়লে দুই দেশের ভ্যাকসিন কূটনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
জানা যায়, তিন দফায় চীন থেকে সিনোফার্মের দেড় কোটি ভ্যাকসিন আনার কথা ছিল। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন ইস্যুতে সামনে আর অগ্রগতি না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ সিনোফার্মের সঙ্গে দ্বিতীয় কিস্তির চুক্তি নাও হতে পারে। আবার সব চুক্তি বাতিলও হতে পারে। তবে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি ঠেকাতে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে সুফলও মিলতে পারে বলে আশাবাদ রয়েছে কূটনীতিকদের মধ্যে।
সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের ক্রয়মূল্য ফাঁস হওয়ার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছিলেন, চীন এতে বিরক্ত এবং ভ্যাকসিন অগ্রগতির বিষয়টি জটিল হয়ে গেল। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, এরই মধ্যে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের দাম প্রকাশ করা বিষয়ে চীনের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমাধান করা গেছে। এ বিষয়ে চীনের কাছ থেকে ইতিবাচক বার্তা আশা করছে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা আমাদের ভ্যাকসিন ইস্যুতে সহযোগিতা করবে।’ এ বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি মন্ত্রী।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চীনের আরেকটি ভ্যাকসিন সিনোভ্যাক ইস্যুতে আসছে সপ্তাহে বৈঠক শুরু হবে। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে। তাই বাংলাদেশ সিনোভ্যাক প্রয়োগে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধে দেশেই যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। খুব দ্রুতই যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরুর ঘোষণা আসবে।’
এদিকে, রাশিয়া থেকে ৫০ লাখ স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন কবে আসবে, তা আগামী সপ্তাহে পরিষ্কার হতে পারে বলে জানাচ্ছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। তারা বলছে, রাশিয়া স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন দেশে যৌথভাবে উৎপাদন করতে দেশটির সঙ্গে একদফা আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা ফলপ্রসূও হয়েছে। দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আশা করা যায়, আসছে সপ্তাহে রাশিয়া চূড়ান্ত আলোচনায় বসবে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার আই ইগ্নটভের জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে ভ্যাকসিন সহযোগিতা নিয়ে আলাপ চলছে। এ বিষয়ে চুক্তির প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে দ্রুতই রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন সহযোগিতা পাবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের আলোচনা সফল হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত আলোচনা করছে। ওই দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। খুব শিগগির ইতিবাচক খবরের আশা করছি।’
কেবল চীন ও রাশিয়া নয়, ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য আরও কিছু দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার (১০ জুন) এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যা আড়াই কোটি হলেও দেশটি ৯ কোটি ৩০ লাখ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। বাড়তি ভ্যাকসিন নষ্ট না করে যেন বাংলাদেশকে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ যোগাযোগ করেছে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। তারা বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেবে বলে জানিয়েওছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরও বলছে, অক্সফোর্ডের-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে এ ইস্যুতে জাপানের জবাব পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।
ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশকে আরও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, শুরুতে একটি উৎস থেকে ভ্যাকসিন আনার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তাই এখন জটিলতা পোহাতে হচ্ছে। তবে এখন কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। ভ্যাকসিন কূটনীতিতে আমাদের কৌশলী হতে হবে।
চীন কেন একেক দেশের কাছে ভ্যাকসিন একেক দামে বিক্রি করবে— এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বলা হচ্ছে যে ভ্যাকসিনের দাম গোপন রাখার শর্ত ছিল। কিন্তু ভ্যাকসিন ইস্যুতে দাম গোপন রাখার কোনো কারণ নেই বলে আমার মনে হয়। দাম গোপন রাখা মানে স্বচ্ছতা নষ্ট করা।
ভ্যাকসিন সংগ্রহের পাশাপাশি সক্ষমতা বাড়াতে উৎপাদনে যাওয়ার পক্ষেই মত দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ শাহান। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তিনি।
ড. আসিফ শাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলার শুরুতেই বাংলাদেশ যে কৌশল নিয়েছিল, তাতে অর্জন ও ব্যর্থতা দুইই আছে। কৌশলের কারণেই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আগেই বাংলাদেশ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করতে পেরেছিল। কিন্তু একক উৎসের ওপর নির্ভর করায় এখন জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ানো। অর্থাৎ ভ্যাকসিনের উৎপাদনে যাওয়া। তাহলে অন্যদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।’
সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর