Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় মৃত্যু ছাড়াল ১৩ হাজার, ৩২ দিনে শেষ এক হাজার

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১১ জুন ২০২১ ২৩:১৪

ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা ভয়ঙ্কর ছিল এপ্রিল মাস। মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনাতেও এপ্রিলের মাসের তথ্য ছাড়িয়ে গেছে অন্যান্য মাসের পরিসংখ্যান। মে মাসের শুরু থেকেই সংক্রমণ শনাক্ত ও করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর হার কমলেও দেশে সম্প্রতি আবার বাড়ছে সেই পরিসংখ্যান। সবশেষ ৩২ দিনেও দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন এক হাজার মানুষ। এর চেয়ে কম সময়ে হাজার মৃত্যু হয়েছে কেবল সেই দুই হাজার মৃত্যুর বেলায়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১১ মে দেশে করোনায় মৃত্যু পেরিয়ে গিয়েছিল ১২ হাজার। তার ঠিক ৩২ দিনে অর্থাৎ ১১ জুন এসে সেই সংখ্যা পেরিয়ে গেল ১৩ হাজার। সে হিসাবে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৪৬১ দিনের মাথায় এসে মৃত্যু ছাড়াল ১৩ হাজারের ঘরে।

শুক্রবার (১১ জুন) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেলেন মোট ১৩ হাজার ৩২ জন।

করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু যেভাবে ১২ হাজার ছাড়াল

দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। সেদিন একজনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে। প্রায় একমাস পর ১৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা স্পর্শ করে ৫০-এর ঘর। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০১ জন।

একমাস পাঁচ দিন পর ২৫ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পাঁচশ। ১৫ দিনের মাথায় ১০ জুন এই সংখ্যা স্পর্শ করে হাজারের ঘর। সে হিসাবে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৯৫ দিনে করোনায় মৃত্যু স্পর্শ করে হাজারের ঘর।

এর ২৫ দিনের মধ্যেই আরও একহাজার মৃত্যুর কারণ হয় কোভিড-১৯। ৫ জুলাই দুই হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু। এর পরের এক হাজার মৃত্যু হয় আরও দ্রুত— মাত্র ২৩ দিনে। ২৮ জুলাই তিন হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্যু।

দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে সময় লাগে ২৮ দিন করে। ২৫ আগস্ট চার হাজার ও ২২ সেপ্টেম্বর পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু। এরপর করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর গতি সামান্য কমে যায়।

২২ সেপ্টেম্বরের ৪৩ দিন পর ৪ নভেম্বর ছয় হাজার, এর ৩৮ দিন পর ১২ ডিসেম্বর সাত হাজার এবং এর ৪২ দিন পর ২৩ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় আট হাজারের ঘর।

এরপর করোনায় মৃত্যুর গতিতে লাগাম ধরানো যায়। আট হাজারের পর ৯ হাজারের ঘরে যেতে সময় লাগে দুই মাসেরও বেশি— ৬৭ দিন। এ বছরের ৩১ মার্চ দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পেরিয়ে যায় ৯ হাজার।

এপ্রিলে এসে করোনায় মৃত্যু সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে। এই মাসেই একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুও দেখেছে বাংলাদেশ। তাতে এপ্রিলের প্রথম ২৫ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয়ে দুই হাজার ৭ জনের। ২৫ এপ্রিল করোনায় মোট মৃত্যু ছাড়িয়ে যায় ১১ হাজার। এপ্রিলের এই ২৫ দিনে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ৮০ জন করে। এপ্রিল মাসে মোট দুই হাজার ৪০৪ জন মৃত্যুবরণ করেন কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে।

এর ১৬ দিন পরে অর্থাৎ ১১ মে এসে মৃত্যু ছাড়ায় ১২ হাজারের ঘর। শেষ এই ১৬ দিনে সুনির্দিষ্টভাবে ৯৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে।

১১ মে ১২ হাজার পাড় হওয়ার পরে গড়ে ৩২ জন করে মারা যায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে। ১১ জুন দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১৩ হাজার।

করোনায় মৃত্যুর প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পুরুষ

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যুবরণকারী ৪৩ জনের ৩০ জন পুরুষ, ১৩ জন নারী। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৩৮০ জন পুরুষ ও ৩ হাজার ৬৫২ জন নারী করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। শতাংশ হিসাবে করোনায় মোট মৃত ব্যক্তির ৭১ দশমিক ৯৮ শতাংশ পুরুষ, ২৮ দশমিক ০২ শতাংশ নারী।

বয়সভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান

গত ২৪ ঘণ্টায় যে ৪৩ জন করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন, তার মধ্যে ২৪ জনের বয়স ষাটের বেশি, ১১ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী চার জন ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী দুই জন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টার মতোই এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণকারী ১৩ হাজার ৩২ জনের অর্ধেকেরই বেশি ষাটোর্ধ্ব। সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে নবজাতকসহ অনূর্ধ্ব-১০ বছর বয়সীদের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত ১৩ হাজার ৩২ জনের মধ্যে সাত হাজার ৪১৫ জনই ষাটোর্ধ্ব। অর্থাৎ করোনায় মোট মৃত্যুর ৫৬ দশমিক ৯০ শতাংশই এই বয়সী।

এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৩ হাজার ১৩৯ জন (২৪ দশমিক ০৯ শতাংশ) ও ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী এক হাজার ৪৫০ জন (১১ দশমিক ১৩ শতাংশ) মারা গেছেন করোনা সংক্রমণ নিয়ে।

মৃত্যুর হার কম বয়সীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে নবজাতক থেকে শুরু করে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছে ৫১ জন (শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ), ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী মারা গেছে ৮৪ জন (শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ)। এছাড়া করোনা সংক্রমণ নিয়ে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২৩৭ জন (১ দশমিক ৮২ শতাংশ) ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৬৫৬ জন (৫ দশমিক ০৩ শতাংশ) মারা গেছেন।

বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সবচাইতে বেশি ১১ জন মারা গেছে রাজশাহী বিভাগে। এছাড়া ৮ জন মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে, ১০ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। সিলেটে বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা না গেলেও খুলনা বিভাগে ৭ জন ও বরিশাল বিভাগে ২ জন মারা গেছে। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন মারা গেছে গত ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুতেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগই এগিয়ে রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ঢাকা বিভাগে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ৭ হাজার ২৬৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫০৩ জন জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে মৃত্যুর হার মোট মৃত্যুর ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮৪৮ জন মারা গেছেন খুলনা বিভাগে, যা মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।

এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৭৬৬ জন (৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৫০৫ জন (৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ), সিলেট বিভাগে ৪৮২ জন (৩ দশমিক ৭০ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৩৯১ জন (৩ দশমিক ০০ শতাংশ) ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন ২৬৮ জন (২ দশমিক ০৬ শতাংশ)।

আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই

দেশে একদিকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাড়ছে সংক্রমণ শনাক্তের হার, অন্যদিকে বিভিন্ন ধরণের ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে। এমন অবস্থায় এপ্রিল মাসের তুলনায় সংক্রমিতদের মৃত্যুর সংখ্যা ও সংক্রমণ শনাক্তের হার কম থাকলেও আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে শনাক্তের হার কমেছে বা কমছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সংক্রমণ একবারেই শেষ হয়ে গেছে। মাস্ক পরার ওপরে জোর দিতে হবে। কোনোভাবেই আমরা এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনের মতো অবস্থায় যেতে চাই না। যতদিন শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে আসবে না ততদিন আমাদের পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। সংক্রমণ কমে আসলে মৃত্যুর পরিসংখ্যানেও তার প্রভাব পড়বে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে।’

জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণ শনাক্তের হার কমেছে দেখে আত্মতুষ্টিতে ভুগে হঠাৎ করে সব বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে এগুতে হবে। সর্বত্র মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জোর দিতেই হবে। যদি এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যায় তবে সংক্রমণ শনাক্তের হার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। একই সঙ্গে তখন মৃত্যুর হারও কিন্তু কমে আসবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘দেশে যদি সবাই মাস্ক পরে তবে অবশ্যই সংক্রমণ শনাক্তের হার কম থাকবে। মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে পারলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে আসে। আর শনাক্তের হার কমে আসলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর পজিটিভ প্রভাব পড়ে। আমাদের পরিসংখ্যানেও দেখা যায় যারা মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব। যদি আমরা তাদের সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনতে পারি তবে মৃত্যুর হারও কমানো সম্ভব।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে করণীয় একটাই- তা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। মাস্ক পরলেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে অনেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর এ অবস্থায় যদি সবাই নিয়মিতভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাসটা চালু রাখতে পারে তবে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসে অনেকটা। একই সঙ্গে অবশ্যই সবাইকে জনসমাগম এড়িয়ে চলতেই হবে। এগুলো করতে পারলে মৃত্যুর হারও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।’

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যা করণীয়

দেশে ২০২১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ শনাক্তের হার বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও তারা সবাইকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।

দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করা। নইলে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কমানো কঠিন। এখন হয়তো সংক্রমণ শনাক্তের হারে কিছুটা নিম্মমুখী ধারা দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সেটাতে সন্তুষ্ট হওয়ার উপায় নেই। করোনাভাইরাসের সমস্যাটি এমন যে, প্রতিরোধ করেই একে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না পারলে পরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এখনো যদি আমরা এই বার্তাটি না বুঝি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি, তাহলে আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

সরকারের বিধিনিষেধ অব্যাহতভাবে জারি রাখার বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে বলে মনে করে ডা. নজরুল। তিনি বলেন, ‘সরকার বিধিনিষেধের সময়কাল বাড়িয়েছে, বাড়াচ্ছে— এমন প্রচারণা শুনছি। কিন্তু এটা কেন ও কী কারণে দেওয়া হচ্ছে তা জনগণকে বোঝাতে হবে। আমার ধারণা, জনগণের কাছে এই ধারণাটি এখনো স্পষ্ট নয়। আর তাই সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো মানা হচ্ছে না। জনগণের কাছে নির্দেশনা স্পষ্ট করতে হবে। তারা মানছে কি না, সেটি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। যারা মানছে না, তারাও যেন মানতে বাধ্য হয়, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে। এটি কেন হচ্ছে? এর জন্য কিন্তু দায়ী অনেক কিছুই। বাণিজ্যিকভাবে ভারত থেকে অনেক ট্রাক আমাদের দেশে পণ্য নিয়ে আসে। সেগুলো আসার পর আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে সেই পণ্য পাঠানোর কাজ করে থাকে। সেখানে কিন্তু খুব একটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে না তারা। এখন দেশে বিধিনিষেধ চলাকালে তো এগুলো বন্ধ রাখা হয়নি। কিন্তু বলা হচ্ছে, লকডাউন সারাদেশে। আদৌ কি তা? সবকিছু নিয়ে হেলাফেলা করতে করতে আজ পর্যন্ত আমরা একটা কাঠামোই দাঁড় করাতে পারিনি। আর এগুলো হয়েছে সমন্বয়হীনতার কারণেই।’

তবে ডা. নজরুলও বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি। তিনি বলেন, সবাই যদি মাস্ক পরে, সবাই যদি অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো ঠিকমতো মেনে চলে, তাহলেই কিন্তু করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব ৯০ শতাংশের বেশি। ফলে মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে, না ধুয়ে চোখে-নাকে-মুখে হাত দেওয়া যাবে না, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। সবাই এগুলো অনুসরণ করলে পরিস্থিতি এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।

সরকারের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন রকমের ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মানুষের অবাধ চলাচলের কারণে বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। তবে ভ্যারিয়েন্টের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানলে তো ভ্যারিয়েন্ট কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আর তাই মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা আজকের এ অবস্থা তৈরি করেছে।’

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়বেই। আর তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। সংক্রমণের উৎস ও উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে তারপর সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সরকারের আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. মোশতাক বলেন, ‘সরকার দেশব্যাপী কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছিল, সেগুলো সবাই অনুসরণ করেছেন— এটি বলা যায় না। এর মধ্যে যেসব এলাকায় সংক্রমণ বাড়ছে সেসব স্থানে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে । তবে এক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি সবাইকে মাস্ক পরার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়েও সবাইকে বোঝাতে হবে। এটা আইন প্রয়োগ করে সম্ভব হবে না। কারণ আইন সেখানেই প্রয়োগ করা যায় যেখানে সবাই সেটা মানে। তাই কঠোর হয়ে নয়, মানুষকে বোঝাতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানা বিষয়ে। একই সঙ্গে যেসব অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে নিতে হবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমাও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণেই জোর দিতে বলছেন সবাইকে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রধানতম করণীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বিশেষ করে মাস্ক পরার অভ্যাসটা চালু করা। কেউ মাস্ক পরে যদি বাইরে যান, তিনি হাঁচি-কাশি দিলেও কিন্তু মাস্ক তার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে। সেইসঙ্গে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে তার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা একেবারেই কমে যাবে। ফলে স্বাস্থ্যবিধিটা সবাইকে মানতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর