নারী ও শিশু নির্যাতনের মিথ্যা মামলায় আইনি প্রতিকারের পথ উন্মুক্ত
১৩ জুন ২০২১ ০২:৩৯
শারীরিক ও যৌন হয়রানি-নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন আইন প্রণয়ন করা হলেও এই আইনটি অপব্যবহার করতে অনেকেই মিথ্যা মামলা দায়ের করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আইনজীবীরা বলছেন, এই আইনের আওতায় মিথ্যা মামলার জন্য সাত বছর সাজাভোগের বিধান থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা মামলার বাদীরা বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে ফেলেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ বাধ্য হয়ে সাজার ভয়ে মীমাংসা করে ফেলেন। কিন্তু আইন মেনে মিথ্যা মামলার শিকার ব্যক্তির প্রতিকার চাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
সারাবাংলার আইন বিষয়ক নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস’-এ যুক্ত হয়ে আইনজীবীরা এ কথা বলেন। এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা’। বরাবরের মতোই অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা ও সঞ্চালনা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফ্ফাত গিয়াস আরেফিন।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক। বিশেষ আলোচক ছিলেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল ৫, ঢাকা’র পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আলী আসগর স্বপন, ছিলেন; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল ৭, ঢাকা’র স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শ্রী প্রাণনাথ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আসগর স্বপন বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ (১) ধারা অনুযায়ী কেউ মিথ্যা মামলা দায়ের করে কাউকে হয়রানি করলে আসামি হেয় প্রতিপন্ন ও অন্যান্য হয়রানির কথা উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের কাছে দরখাস্ত করে প্রতিকার চাইতে পারেন। তখন আদালত ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২০০ ধারা অনুযায়ী বাদীর বক্তব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিপক্ষকে সমন জারি করেন। মামলার নিয়ম অনুযায়ী ভুক্তোভোগীকেই মামলা করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় মিথ্যা মামলা খারিজের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আবেদন করে থাকে। ক্ষতিগ্রস্তের দায়ের করা মামলা প্রমাণ হলে বাদীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালে এরকম মামলা খুব কম হয় বলে জানান তিনি।
শ্রী প্রাণনাথ বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিভিন্ন ধারায় মিথ্যা মামলা অনেক হয়— এটি সত্য। তবে এসব মামলার রায় হতে হতে অনেকসময় পাঁচ থেকে সাত বছরও লেগে যায়। ফলে মামলা আর বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং এটি খরচসাপেক্ষ হওয়ার কারণে আসামিরা মামলা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এই আইনে মামলার সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পেছনে আইনজীবীদেরও ভূমিকা আছে বলে মন্তব্য করেন শ্রী প্রাণনাথ। তিনি বলেন, আমরা অনেকসময় সমাধানের পথ বাৎলে না দিয়ে বাদী আসার সঙ্গে সঙ্গে মামলা করার পরামর্শ দেই। এসব কারণেও অনেক মিথ্যা মামলা হয়।
এসময় লাইভে যুক্ত হয়ে একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, তার খালাতো ভাইকে মিথ্যা মামলায় সাজা ভোগ করতে হয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, তার ভাইয়ের কাবিনের পর অনুষ্ঠান করে বউ তুলে আনা হয়নি। মাঝেমধ্যে তিনি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতেন। এর মধ্যেই তাদের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে ও তার ভাই ডিভোর্স দিয়ে দেন। ডিভোর্সের অনেক পরে খালাতো ভাই ও তার বৃদ্ধ মা-বাবার বিরুদ্ধে যৌতুক দাবি ও নির্যাতনের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। মামলায় ডিভোর্সের তথ্য গোপন করা হয় এবং শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের একটি ব্যবস্থাপত্র উপস্থান করা হয়। মামলায় বেশ কিছুদিন কারাভোগ করতে হয় ওই ব্যক্তিকে। পরে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাপত্র ইস্যুই করেননি। অর্থাৎ জালিয়াতির মাধ্যমে ওই ব্যবস্থাপত্র তৈরি করা হয়েছিল।
লাইভে যুক্ত হওয়া ওই নারী বলেন, মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে তার ভাইকে হয়রানি করা হয়েছে। তিনি এর আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন কি না।
ঘটনাটি শুনে অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক বলেন, ক্রিমিনাল জাস্টিস আইনের একটি বিষয়ই হচ্ছে যেসব আইনের শাস্তি বেশি কঠিন, প্রবেশন বাধ্যতামূলক, সেসব আইনের আওতায় মিথ্যা মামলা বেশি হয়। পেনাল কোড ও বিশেষ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল— উভয় ক্ষেত্রেই এমন ঘটে।
তিনি বলেন, মামলা আপস-নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আবার প্রতিকার চাওয়া যায়, যদি নির্যাতন মামলায় কোনো গড়মিল থাকে। যেমন— এক্ষেত্রে ডিভোর্সের পরে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের মামলা করা হয়েছে। এমন হলে প্রতিকার চেয়ে বাদীর বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। এক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে মামলাটি মিথ্যা ছিল। আর তিনি বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে আপস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে— যেহেতু এমন মামলার নজির আমাদের দেশে নেই, তাই আপসনামাটি বিবাদীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। বাদী পক্ষ বলতে পারে যে মামলা মিথ্যা হলে তারা আপস করল কেন? এরকম প্রতিবন্ধকতা থাকলেও কেউ প্রমাণ করতে পারলে প্রতিকার চেয়ে মামলা করা উচিত।
অভিজ্ঞ এই আইনজীবী আরও বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা ঘরে-বাইরে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। মিথ্যা মামলা হচ্ছে— এটি যেমন সত্য, তেমনি অনেক নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে মামলা হচ্ছেই না— এটিও বাস্তবতা। মামলা করার সাহস না থাকা, পরিস্থিতি না থাকা, আইন-আদালত সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা, বাইরে না যাওয়ার অভ্যাস থাকা ইত্যাদি কারণেও অনেকে নির্যাতন মামলা করার সাহস করে উঠতে পারেন না। আবার অনেকসময় নারী অভিযোগকারী পুরুষ আইনজীবীকে সব কথা খোলামেলা বলতে পারেন না। এভাবেও অনেক নারী আইনের সুবিধা নিতে পারেন না। নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যেন কেউ এর সুযোগ নিয়ে নিরপরাধ কাউকে সাজা না দেওয়াতে পারে।
অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল আরও বলেন, অনেকসময় আইনজীবীরাও স্বামী ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যদের জড়িয়ে মামলা করার পরামর্শ দেন মামলা শক্তিশালী করার জন্য। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আইনজীবী ও বিচারকসহ এই ট্রাইবুন্যালের সঙ্গে জড়িত সবাই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা না হওয়ার ব্যাপারে সচেতন হবে।
আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ বলেন, আইন সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা না থাকার জন্যই কেউ পরবর্তী সময়ে প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করেন না। একটি জাল ডকুমেন্টস কিন্তু পুরো মামলা না। অনেকসময় নির্যাতন ঘটতেও পারে। ঘটনা মিথ্যা কি না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ মামলা নেওয়া বা তদন্ত করার সময় বের করা সম্ভব না। আদালতে স্বাক্ষী-সাবুদ প্রদর্শন ও বিচারকাজের পর আদালত বুঝতে পারবেন মামলাটি মিথ্যা কি না। যদি মামলা মিথ্যা হয়েও থাকে, সেটি আদালতে রায় হওয়ার পরই বলা যাবে মিথ্যা কি না। আদালতের রায়ে মিথ্যা ঘোষণা হওয়ার পর ভুক্তোভোগী এই রায়ের কপির ওপর ভিত্তি করে প্রতিকার চেয়ে মামলা করতে পারেন। আদালত সেই মামলা অবশ্যই নেবেন, যদি এমন ঘটে থাকে। তবে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এমন অভিযোগ করেছেন বলে জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে আইন-বিচার সবখানেই বাঙালি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার একটি প্রবণতা রয়েছে। সবাই শুরু থেকেই শাস্তির চিন্তা না করে নিষ্পত্তির চিন্তা করেন। এটি অনেকসময় ভালো হলেও অনেকের জন্যই নেতিবাচক।
এই আয়োজনে বক্তাদের কথায় আরও উঠে আসে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে আমাদের দেশের একটি তুলনামূলক চিত্র। তারা বলেন, ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় মামলা দায়েরের আগে প্রসিকিউটর আগে দেখেন কাগজপত্র সব ঠিক আছে কি না। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার জন্য তারাই তদন্ত করেন। যদি মনে করেন যে সেই মামলায় বাদীর জেতার সম্ভাবনাই বেশি, তবেই মামলা দায়ের করেন। এ কারণেই ওসব দেশে নারী নির্যাতন দমন আইনে ৯০ শতাংশের বেশি সাজা হয়, আর আমাদের দেশে হয় তিন শতাংশ। তাই বক্তারা সব মহলকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান, যেন সত্যিকারের সহিংস ঘটনার ক্ষেত্রে জড়িতরাই সাজার আওতায় আসে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
আইনি প্রতিকার নারী ও শিশু নির্যাতন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন মিথ্যা মামলা সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার