Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন

রাজনীন ফারজানা
১৫ জুন ২০২১ ০৮:০০

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।।
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন হলেও নতুন মেঘের ঘনিমার দিকে চেয়ে বৃষ্টির সুবাসে হৃদয়ে দোল লাগতে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। এবার যে জৈষ্ঠ্য মাসেই বৃষ্টি-বাদল শুরু। বৈশাখ আর জৈষ্ঠ্যের তীব্র গরমের প্রকৃতিতে আষাঢ় আসে হৃদয়ে শীতলতার পরশ বুলাতে। কিন্তু বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের ফাঁদে পড়ে এবার যেন কিছুটা আগেই চলে এসেছে বৃষ্টি-বাদলার দিন। তাই আজ পহেলা আষাঢ় হলেও বর্ষাকালের মেঘ-বৃষ্টি ঘিরে বাঙালির যে রোমান্টিকতা, তাও যেন কিছুটা আগেভাগেই চলে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

আষাঢ়ের জীবনযাত্রা
আষাঢ়ের কি আবার আলাদা জীবনযাত্রা হয়! আসলে আধুনিক এই ব্যস্ত সময়ে সেটি কিছুটা অবাস্তব শোনালেও আষাঢ় ঘিরে বদলে যায় বাঙালির জীবনযাত্রাও। এযে জলের দেশ, নদী, খাল আর বিলের দেশ। ভরা বর্ষায় মাঠঘাট চরাচর যখন ভেসে যেত বানের জলে, তখন বদলে যেত আবহমানকালের বাঙালি জীবনযাপনও। জল বাঁচিয়ে কোনরকমে রান্নাখাওয়া সেরেই সবাইকে আশ্রয় নিতে হত ঘরে। এসময়ে নারীরা ব্যস্ত হত নানারকম সৃজনশীল কাজে। নানারকম সুচিকর্ম, কারুকার্য ইত্যাদিতে সময় কাটাতেন তারা। অন্যদিকে এই বর্ষাতেই জমে উঠত নৌকা বাইচ উৎসব।
সেসব দিন গত হয়ে বাঙালি জীবনে প্রবেশ করেছে শহুরে জীবনযাপনের নানা বৈচিত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যেতে বর্ষার ঝাপটায় ভিজেনেয়ে একসা হওয়া যখন সেই জীবনের অংশ তেমনি পাকা রাস্তায় জল জমে মোটরগাড়ি আটকে যাওয়াও সেই জীবনের অংশ। এমনকি খোদ রাজধানীসহ বড় বড় শহরের প্রধান প্রধান শহরে জল জমে যাওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে বর্ষা আসার আগেই। চট্টগ্রামের মত শহরে বহুতল ভবনের সামনে গাড়ির বদলে নৌকা বেঁধে রাখার চিত্রও দেখা গেছে দুয়েক বর্ষা আগে। আবার এসময়েই দেখা দেয় নানারকম রোগব্যাধিও।
জলাবদ্ধতা, রোগশোক স্বত্বেও বাঙালি জীবনে এখনও আষাঢ় আসে রোমান্টিক বার্তা নিয়েই। তাইতো বৃষ্টির দেখা পেতে না পেতেই ঘরে ঘরে চুলায় বসে খিচুড়ির হাড়ি। বৃষ্টির দিন খিচুড়ি আর সামর্থ্য অনুযায়ী আচার, ভর্তা, ডিম বা মাছ-মাংসের নানা আয়োজন করে শহুরে বাঙালি। তাই বলা যায়, খিচুড়িও যেন এখন বৃষ্টিযাপনের অংশ। ঠিক তেমনি বর্ষার আরেক উপাদেয় খাবার গরম গরম চায়ের সঙ্গে ভাজাপোড়া। বৃষ্টি বিকেলে চায়ের আড্ডায় পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যেন অন্যরকম উৎসবে মেতে উঠি আমরা।
বৃষ্টির সঙ্গে আলস্য আর গল্পগুজবের যেন সুপ্রাচীন সম্পর্ক। প্রাচীন বাংলায় যেমন মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সুদূর গ্রাম থেকে ভেসে আসত বাঁশির সুর অথবা ভাটিয়ালি-কীর্তনের সুর, তেমনি ঘরে বসে গল্পগুজবেও কাটত সময়। কত আর জানা গল্প বলা যায়, কাহিনীর আগামাথা ছাড়িয়ে গল্পের গরু হয়ত গাছেই উঠে পড়ত। এভাবেই হয়ত আষাঢ়ে গল্পের নামকরণ। এখনও বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যার পর ভুত-প্রেত আর রূপকথার গল্পে মেতে ওঠা বা পড়া বাঙালির প্রিয় অভ্যাস। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মুভি দেখা, গান শোনা, রেডিও শোনা ইত্যাদি নানা নতুন নতুন অভ্যাস যুক্ত হয়েছে আমাদের জীবনযাপনের তালিকায়।

বিজ্ঞাপন

ফেসবুককেন্দ্রিক বর্ষাযাপন
বাঙালি জীবনযাপনের কথা বললে ফেসবুকের কথা না বললে তা অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আগেও আমরা আমাদের দৈনন্দিন সুখদুঃখ, হাসিকান্না ভাগাভাগি করার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককেই বেছে নিয়েছি। এই ঘনবসতির দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মানুষের জন্য বাইরে যেয়ে প্রকৃতিযাপন করা অনেকাংশেই সম্ভব না। তাই তো একফোঁটা বৃষ্টি নামতে না নামতেই ফেসবুকের টাইমলাইন জুড়ে দেখা যায় হাজারো স্টেটাস, লাইভ ভিডিও আর নানারকম অনুভূতির প্রকাশ। কেউ করেন স্মৃতি রোমন্থন, কদম ফুলের ছবি দেন কেউ কেউ। কেউ আবার জানালা দিয়ে দেখা এক চিলতে বৃষ্টিতে হাত ভেজানোর ছবি বা ভিডিও দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন, কেউ বা আবার বৃষ্টিদিনের খিচুড়ি বা চায়ের ছবি শেয়ার করেন। অনেকেই আবার বৃষ্টি নিয়ে প্রিয় গান বা কবিতাও শেয়ার দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়। এভাবে আরও অনেককিছুর মতই আমাদের আধুনিক শহুরে বাঙালির আষাঢ় যাপনও এখন অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক।

আষাঢ়ের গান-কবিতা
বৃষ্টি ঘিরে বরাবরই রোমান্টির আমাদের কবি আর সঙ্গিত রচয়িতারা। এক রবীন্দ্রনাথেরই রয়েছে অসংখ্যা কালজয়ী কবিতা ও গান। এখনও বাঙালি বৃষ্টি নামলেই নিজের অজান্তেই গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গিতের দুয়েক কলি বা কবিতার চরণ। লেখার শুরুতেই কবিগুরুর গানের চরণ দিয়েই শুরু। বাংলা ১৩০৭ সালেও যেন এখনকার মতই আষাঢ় কিছুটা আগেই এসেছিল। সেই সনের ২০ জ্যৈষ্ঠ শিলাইদহ বসে কবি লেখেন ‘আষাঢ়’ শিরোনামের কবিতা যার প্রথম দুই চরণ— নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥

বর্ষা নিয়ে কথা বললে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কথা বলতেই হয়। অনেকেই বলেন, বাংলার তরুণ প্রজন্মকে নাকি বৃষ্টি ভালবাসতে শিখিয়েছেন তিনি। তার রচিত অসংখ্য উপন্যাস ও গল্পে তিনি বৃষ্টি ঘিরে অন্যরকম মাদকতা সৃষ্টি করেছেন। অনেকেই বলেন, তাদের নাকি বৃষ্টিতে ভিজিতে শিখিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। তার রচয়িত ও শাওনের কণ্ঠে— যদি মন কাঁদে তবে চলে এস এক বরষায় গানটিও বর্তমান সময়ের তরুণ হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।

অন্যদিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা যেন প্রেম আর বিরহের উৎসারক। কে ভুলতে পারে সেই অমর গান—
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে… নয়নে বারি ঝরে।
ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম/ আঁচলের গাথা মালা ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে… নয়নে বারি ঝরে।/শাওন রাতে যদি…

আবার শাওন রাতে প্রিয়তমকে মনে করে কবি গেয়েছেন—
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।/হায়, রহি রহি সেই পড়িছে মনে॥
বিজলিতে সেই আঁখি/ চমকিছে থাকি থাকি,/ শিহরিত এমনই সে বাহু-বাঁধনে॥

আধুনিক বাংলা কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় আবার উঠে এসেছে আধুনিক বাঙালি জীবনের ছবি। রবি ঠাকুর যেমন এমন দিনে তারে বলা যায় বলে প্রিয়কে কাছে ডাকার আহ্বান করেছেন। শামসুর রাহমান এঁকেছেন একদমই নাগরিক চিত্র—
কাঁচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি। বাদল দিনের ফুল/ কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে।
এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে কেউ/ নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ ব’লে ডাকুক তোমাকে?

কবি সুফিয়া কামালের কবিতায়ও বর্ষা অনেক বেশি আকাংখিত ও প্রত্যাশিত। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমের পর বর্ষা আমাদের মনে ও শরীরে আনে পুলকিত শিহরণ। কবি বলেছেন—
আমি বর্ষা, আসিলাম/ গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে/ মমতায় বর্মপুট ভরি।

বাংলা গান ও কবিতায় বর্ষাবন্দনার কোন সীমারেখা নাই। সব যুগেই সব সাহিত্যিকই নিজের মত করে বর্ষা ঘিরে রচনা করেছেন অমর উপাখ্যান। খুব অল্পকিছু উদাহরণই টানা গেল এযাত্রা। বর্ষা নিয়ে কবিতার কথা আসলে পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের দুটি চরণ না দিলেই নয়। রইলো তার বিখ্যাত পল্লীবর্ষা কবিতার কিছু চরণ—
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,/কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
‘কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,/ ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,/ সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা/ তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!


আষাঢ়ের ফুল
বর্ষা মানেই যেন সুবাসিত চারপাশ। নানাবর্ণ আর রূপের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতিকে ফুলের সৌরভে ভরিয়ে তোলে বর্ষারাণী। তবে আষাঢ়ের অপেক্ষায় এবার বসে থাকেনি বাদল। তাই তো বাদল দিনের প্রথম কদমফুলও এবার আগেভাগেই দেখা দিয়েছে। কদম ছাড়াও এসময়ে দেখে মেলে কেয়া, জুঁই, চালতা ফুল, কামিনী, বেলি ও বকুল, গন্ধরাজ, রঙ্গন, রক্তজবা, টগর, শ্বেতকাঞ্চন, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, দোপাটি ও অলকানন্দার মত ফুল।
আবার বর্ষা মানেই জল। আর জল মানেই জলজ ফুলের মেলা। তাই বর্ষা আসতে না আসতেই জলের গায়ে মেলা বসে শাপলা-শালুক-পদ্মর। আবার অবহেলিত হলেও এসময়ে কচুরিপানা ফুলও বর্ষাঋতুর সৌন্দর্যে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা।

সারাবাংলা/আরএফ

আষাঢ়ের প্রথম দিন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর