Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুর কারাকুঠুরির সামনেই খোঁড়া হয়েছিল কবর

ফিচার ডেস্ক
১৫ জুন ২০২১ ১৬:২৬

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পরপরই তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেই রাতে তাকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন তাকে নেওয়া হয় ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে, সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচিতে স্থানান্তর করা হয়। করাচি বিমানবন্দরের পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সামরিক অভিযানের সাফাই গেয়ে জানালেন, ‘তিনি (শেখ মুজিব) এই দেশের (পাকিস্তানের) ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত হেনেছেন—এই অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে।…… আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’

পাকিস্তানে নেওয়ার পর কোথায় বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়, তাকে নিয়ে কী করা হবে, এসব বিষয়ে সরকার সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে। বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে হাজার মাইল দূরের কারাকুঠুরিতে বন্দি করে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে নাবিকবিহীন হালভাঙা নৌকায় পরিণত করতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা। কিন্তু লাখো মানুষের অন্তরে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি সময়ের সঙ্গে আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠে।

৩০ মার্চের ঢাকা শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকির স্মৃতিকথন ‘ইস্ট পাকিস্তান দ্য এন্ডগেম’ গ্রন্থে লিখেছেন, যখন আর্মি জিপ নিয়ে শহর ঘুরে ফিরছিলেন নবাবপুর রোড হয়ে। তার জবানিতে জানা যায়, ‘নবাবপুর রোড দিয়ে যাওয়ার সময় এক তরুণ আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল উদ্ভ্রান্ত, আমরা থামতেই সে চেঁচাতে শুরু করল। তার চেহারা-সুরত একেবারে ছন্নছাড়া। সে বলল, বাঙালিরা দৃঢ় পণ করেছে তারা শেখ মুজিবকে মুক্ত করবে, এ দেশকে স্বাধীন করবে। কিছুক্ষণ তার কথা শুনে আমরা আবার জিপে উঠলাম। এই অচেনা আগন্তুকের সঙ্গে বাদানুবাদ করে লাভ নেই, কারফিউ জারি করা এলাকায় সে এক নিঃসঙ্গ পথচারী মাত্র।’

করাচি থেকে কালবিলম্ব না করে কঠোর গোপনীয়তায় বঙ্গবন্ধুকে নেওয়া হয় লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে। একাধিক কেন্দ্রীয় কারাগার থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে দূরবর্তী জেলা শহরের কারাগারে আটক করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাকে মানসিকভাবে পিষ্ট করা। পর্বতমালায় ঘেরা মিয়ানওয়ালী কারাগার। সেখানে প্রায়ই শিলাবৃষ্টি নেমে আসত। ধূসর মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে মিশে থাকত। সেদিক দিয়ে লায়ালপুর, বর্তমান ফয়সলাবাদ, যোগ্য স্থানই বটে; কেননা লায়ালপুর পাকিস্তানের উষ্ণতম স্থান, গ্রীষ্মে এখানে তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ছাপিয়ে যায়, বন্দীদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তদুপরি বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়েছিল নিঃসঙ্গ সেলে, গরমে তেতে ওঠা সেই কারাকক্ষে কোনো পাখাও ছিল না।

বিজ্ঞাপন

একদিন দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন- তার সেলের দশ গজ সামনে কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে কয়েকজন কয়েদি একটি বড় গর্ত খুঁড়ছে। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অবাক হলেন। কাছে এসে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, কবর খোঁড়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বুঝতে অসুবিধা হল না, ওটা তার জন্যই তৈরি করা হচ্ছে; সম্ভবত দুয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকে আটকের পর ইয়াহিয়ার ইচ্ছা ছিল, নামে মাত্র একটি বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা। এসময় লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া জানায়- সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব শিগগিরই বঙ্গবন্ধুর বিচার কাজ শুরু করবে। এই বিচার হবে সিক্রেট মিলিটারি ট্রাইবুন্যালে। চার্জশিটে মৃত্যুদণ্ডের কয়েকটি ধারা থাকবে বলেও জানায় সে।

পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর আটক থাকার প্রথম স্বীকৃতি মেলে ১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এ প্রকাশিত একটি খবরে। এরপর ৮ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সানডে টাইমস জানায়–পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিব জীবিত ও সুস্থ আছেন। সেসময় ধৃষ্টতাপূর্ণভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া আরও বলে যে- আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না।

১৯ জুলাই যে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর আসন্ন বিচারের বার্তা প্রকাশ করল, তার নেপথ্যে ছিল একটি বড় আন্তর্জাতিক ঘটনা। ৬ থেকে ৮ জুলাই মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি সফর করেন। এরপর পাকিস্তানে এসে অসুস্থতার ভণিতা করে পাকিস্তানি জেনারেলের দূতিয়ালিতে অত্যন্ত গোপনে হেনরি কিসিঞ্জার চীনে যান এবং মাও সে তুংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। চীন-মার্কিন ঐতিহাসিক আঁতাত নির্মাণের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছিল মার্কিন প্রশাসন। পাকিস্তান-মার্কিন কূটনীতির বিপুল এই সাফল্য ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন ঘটাতে সবুজ সংকেত দিয়েছিল। ১৭ জুলাই মার্কিন প্রশাসন হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চীন সফরের বিবরণ প্রকাশ করে। এর দুই দিন পরই ইয়াহিয়া খান বার্তা দেন বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের।

এর কয়েক দিন পর পয়লা আগস্ট পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বড় আকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে বিচার যে অত্যাসন্ন, সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।’

বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছিল। যখন কোনোভাবেই আর বঙ্গবন্ধুকে টলানো যাচ্ছিলো না, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে সে প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর একটি মিটিং হয়। এই দুই নেতার কথোপকথন তুলে ধরেছেন রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার: দ্য ট্রাজিডি অ্যাট বাংলাদেশ’ গ্রন্থে।

সেই বিবরণ থেকে জানা যায়, ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বললেন- ‘প্রথমেই আমাদের এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের দুটি পৃথক জাতি হওয়া চলবে না। যেভাবেই হোক আমাদের সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। অবশ্য তা আগের মতো নয়, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বলে চেনা যায় এমন একটি দেশ হিসেবে। আর যা হোক না কেন, আমাদের ধর্ম ও উদ্দেশ্য অভিন্ন।’ কিন্তু মুজিব বললেন, ‘না’। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি, করাচি থেকে লন্ডনের যান কারামুক্ত শেখ মুজিব, ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে নিজ ভূমে ফেরেন নেতা।

সারাবাংলা/এসএসএ

বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুর কারাকুঠুরির সামনেই খোঁড়া হয়েছিল কবর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর