Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বই দিয়ে গড়া কলেজের গেট

সুলতান হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুন ২০২১ ০৮:৫৫

লালমনিরহাট: স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের অনেক চমৎকার ও নান্দনিক গেট নির্মাণ নতুন কিছু নয়। এরকম নান্দনিকতার দর্শন পেতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষজনের ছুটে আসাটাই স্বাভাবিক। ঠিক তেমনই লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া আদর্শ কলেজের মূল গেটটি দেখতেও ছুটে আসছেন লোকজন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে এই গেটের নকশাটি কেবল নান্দনিকই নয়, একদম ব্যতিক্রমধর্মীও বটে। কারণ এই গেটটি আর কোনো কিছু নয়, তৈরি হয়েছে বইয়ের আদলে!

বিজ্ঞাপন

হ্যাঁ, এমনই অভিনব নকশার এক গেট নির্মাণ করা হয়েছে দইখাওয়া আদর্শ কলেজে। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এর প্রবেশমুখ থেকেই যেন তার ছোঁয়া পাওয়া যায়, সেই চিন্তা থেকেই বইয়ের নকশায় তৈরি করা হয়েছে এই গেট। আর তা দেখলেই লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলা তো বটেই, আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগে অভিভূত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাতীবান্ধা-চাপারহাট অঞ্চলিক সড়কের পাশেই অবস্থিত দইখাওয়া আদর্শ কলেজ। আর এই কলেজে ঢোকার মুখেই রয়েছে বইয়ের আদলে গড়ে তোলা মূল ফটক। সাহিত্যানুরাগীদের জন্য এই গেটটি যেন বিশেষ কিছু। কেননা, দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিকদের ৫০টিরও বেশি বই যেন এই গেটের দুই স্তম্ভ গড়ে তুলেছে।

দেখা গেল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলজয়ী কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি, বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা থেকে শুরু করে মহাকবি কায়কোবাদের মহাশ্মশান, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত, ডা. লুৎফর রহমানের মহৎ জীবন, সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদীনের সারাজীবন, হুমায়ুন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার— এমন সাহিত্যরত্নের কী নেই এই গেটে। আবার গেটের ওপরে রয়েছে একটি গ্লোব, যেখানে বিভিন্ন দেশের পতাকা অঙ্কিত রয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন এক শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলোর আর দশটি জাতীয় শহিদ মিনারের মতো হলেও এর পেছনের অংশটি একটু আলাদা। স্তম্ভগুলোর পেছনে গোটা শহিদ মিনারকে যেন আঁকড়ে ধরে রেখেছ একটি বই, যেখানে রয়েছে বর্ণমালা, আর দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন সময়কার গল্প।

বিজ্ঞাপন

এই দইখাওয়া আদর্শ কলেজ আরও অনেক দিক থেকেই অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এই কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের। অনেকেই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতে পারে না। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, দুপুরে অল্প টাকায় খাবারের ব্যবস্থা করা হবে শিক্ষার্থীদের জন্য। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা এই কলেজের ক্যান্টিনে মাত্র ১০ টাকায় দুপুরের খাবার খেতে পারে। কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য এ ক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষের ডাকে সাড়া দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সম্পদশালী ব্যক্তিরা।

কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৯৯৯ সালে হাতীবান্ধা দইখাওয়া আদর্শ কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় থেকেই এর একটি মূল গেট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা ছিল না কলেজের তহবিলে। এর মধ্যেই গত বছরে মার্চে ব্যতিক্রমধর্মী নকশায় এই গেট নির্মাণের চিন্তা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিভাবে সেটি হতে পারে, সে বিষয়েও তারা ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত নেন।

ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী যারা সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিক্ষকরা। কিভাবে গেটটিকে একদম আলাদা করে গড়ে তোলা যায়, সে বিষয়ে তাদের মাধ্যমে চারুকলার শিক্ষার্থীদের সহায়তা চান। আর এভাবেই বইয়ের আদলে গেটটির একটি নকশা চূড়ান্ত হয়।

নকশা তো হলো, কিন্তু গেটটি নির্মাণের টাকা আসবে কোথা থেকে? সেখানেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সাবেক শিক্ষার্থীরা এবং তাদের সূত্র ধরে চারুকলার বেশ কয়েকজন। তারা জানান, নির্মাণ সামগ্রী দিল তারা কোনো পারিশ্রমিক না নিয়েই বানিয়ে দেবেন গেটটি। কলেজ কর্তৃপক্ষ এ পর্যায়ে কলেজের তহবিল থেকে বরাদ্দ দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সহায়তা আসে আরও অনেক জায়গা থেকেই। শেষ পর্যন্ত একবছরের প্রচেষ্টায় ব্যতিক্রমধর্মী এই গেটটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। তা দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে সবার।

দইখাওয়া কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মমতাজ সাথী বলেন, শিক্ষকদের সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনার প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কলেজের এমন একটি গেটের চিন্তাভাবনা আসলে অনেকদিন থেকেই ছিল। ভাবনাটা এমন ছিল, বই যেহেতু জ্ঞানের ভাণ্ডার, তাই বইয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে গেটে। এখানে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের অনেক বইকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে জ্ঞানচর্চা প্রয়োজন, সেটি যেন কলেজে প্রবেশের আগেই বুঝিয়ে দেবে এই গেট।

কলেজের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল-আমিন ইসলাম বলেন, মূলত শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এই গেটটি তৈরি করা হয়েছে। বই পড়লে বিশ্বের সবকিছু হাতের মুঠোয় থাকবে— এমন একটি বার্তাই এই গেটের মাধ্যমে দিতে চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

রফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দাএকজন বলেন, আগে তো অনেক দূরে দূরে গিয়ে কলেজে পড়ালেখা করতে হতো। এখন গ্রামের মধ্যেই সুন্দর একটি কলেজ হয়েছে। বিশেষ করে এই কলেজের এরকম গেট সত্যিই অন্যরকম। এরকম গেটের কথা কখনো শুনিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ২০০৪ সাথে কলেজটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কলেজটির ফলাফলও পর্যায়ক্রমে ভালো হতে থাকে। কিন্তু কলেজের সীমানা প্রচীর না থাকায় গেটও নির্মাণ করা যায়নি। বলা যায় কলেজ অনেকটা অরক্ষিত ছিল।

অধ্যক্ষ বলেন, একপর্যায়ে এরকম একটি গেট নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসেছে। আমাদের সাবেক শিক্ষার্থীরাও সহায়তা করেছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল বই নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা। এখন মনে হচ্ছে আমাদের সেই লক্ষ্য সফল হয়েছে।

সারাবাংলা/টিআর

দইখাওয়া আদর্শ কলেজ লালমনিরহাট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর