Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগল ভাঙছেন, স্বাবলম্বী হতে ধরেছেন স্টিয়ারিং

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুন ২০২১ ১৪:১৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তরুণী নিশাত আক্তার পাখির বসবাস সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত বস্তিতে। স্বামী প্রাইভেট কার চালান। নিশাত নিখাদ গৃহিণী। টানাটানির সংসার। পাখি একদিন ভাবলেন, নিজেও কিছু আয় করতে পারেন, সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফেরাতে পারেন ইচ্ছা করলে। সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বামীর মতো গাড়িই চালাবেন। শুরুতে স্বামীর আপত্তি ছিল। কিন্তু ইচ্ছার জোরে নিশাত ভর্তি হয়ে যান চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদে বাংলাদেশ-কোরিয়ান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। শিখছেন মোটর কার ড্রাইভিং। স্বপ্ন সরকারি কিংবা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালানোর চাকরি নেবেন।

বিজ্ঞাপন

নিশাত একা নন, তার দেখাদেখি বস্তির আরও কয়েকজন নারীও এই পেশায় আসতে শিখছেন মোটর কার ড্রাইভিং। পরিবারের সদস্যদের আপত্তি, প্রতিবেশীদের টিপ্পনী-সমালোচনা সবকিছু উপেক্ষা বিভিন্ন বয়সের কমপক্ষে ২০ নারী এখন স্বপ্ন দেখছেন— গাড়ি চালিয়ে স্বাবলম্বী হবেন। একেবারে সুবিধাবঞ্চিত স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত এসব নারীদের মনে এই সাহস এনে দিয়েছে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) নামে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন।

বিজ্ঞাপন

নিশাত আক্তার থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর এলাকায় রেললাইন সংলগ্ন তুলাতলী বস্তির লাকীর মা’র কলোনিতে। নিশাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এই পড়ালেখায় তো ভালো কোনো চাকরি জুটবে না। অথচ আমার কাজ দরকার। ওই সময় বিএনপিএস’র ভাইদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যেহেতু আমার স্বামী প্রাইভেট কার চালান, আমিও সেই কাজই করব সিদ্ধান্ত নিলাম। বিএনপিএস’র ভাইয়েরা আমাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে শিখে আমি যদি ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পাই, চাকরির অভাব হবে না। এখন অনেক এনজিও-ক্লিনিকে মহিলা ড্রাইভার নিচ্ছে। সরকারি চাকরিরও সুযোগ আছে।’

নিশাতের মতো একই বস্তির ত্রিশোর্ধ নারী লাকী আক্তারও শিখছেন মোটর ড্রাইভিং। স্বামী, একাধিক সন্তান নিয়ে লাকীর সংসার। সব সামলে লাকীও প্রতিদিন ছুটেন ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।

লাকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েরাও যে গাড়ি চালাতে পারে কিংবা গাড়ি চালানো শিখতে পারে— সেটা আমরা জানতামই না। কোথায় মেয়েদের গাড়ি চালানো শেখানো হয়, সেটাও জানতাম না। বিএনপিএস’র মাধ্যমে আমি ভর্তি হয়েছি। প্রথম একমাস ভালোভাবেই শিখেছি। এখন করোনার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। এরপরও লেগে আছি। ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পেলে একটা চাকরি পাব। আমার বয়স হয়ে গেছে, হয়তো সরকারি চাকরি পাব না। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এর মধ্যেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম শহরে নারীরা গাড়ি চালাচ্ছেন জীবিকার তাগিদে— একদশক আগেও এমন দৃশ্য ছিল বিরল। নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর নারীদের স্কুটি চালাতে দেখা যেত শুধু, তা-ও মাঝে মাঝে। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্পটে বিত্তশালী পরিবারের নারীদের শখের বশে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস প্রশিক্ষণ নিতে ও চালাতে দেখা গেছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গাড়ি চালিয়ে সড়কে বের হয়েছেন নারী— এমন দৃশ্যেরও দেখা মেলে কদাচিৎ।

কিন্তু জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নারীদের গাড়ি চালানো— চট্টগ্রাম শহরে এখনো সে চিত্র দৃশ্যমান নয়। এর ওপর সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বস্তিবাসীদের মধ্য থেকে নারীরা গাড়ি চালানোর মতো কাজে যুক্ত হয়ে রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে বেরিয়ে আসবেন, সেটা হয়তো অনেকের কাছে একেবারেই কল্পনার অতীত। নিশাত আর লাকীরা বলছেন, সেই অত্যন্ত কষ্টকল্পিত বিষয়টিকেই তারা বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন। পরিবার-প্রতিবেশী, সমাজের মানুষের শত বাধা-ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই তারা এই চ্যালেঞ্জ জিততেই স্টিয়ারিংকে হাতিয়ার করেছেন।

 

বঞ্চিত এলাকার নারীদের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আটটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন বস্তিতে ‘প্রোমোটিং রাইটস থ্রু মোবিলাইজেশন অ্যান্ড এম্পাওয়ারমেন্ট’ (প্রাইম) নামে একটি প্রকল্প শুরু করে বিএনপিএস। আটটি ওয়ার্ডের ১০০টি তৃণমূল দলে এক হাজার ৯৭৬ জন নারীকে নিয়ে তারা কাজ করছেন বলে জানালেন বিএনপিএস, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ এরশাদুল করিম।

চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন বস্তির স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর নারীদের অনেকেই শুধু গাড়ি চালানো নয়, সেলাই-পার্লারের কাজ, এমনকি সামান্য শিক্ষিতরা কম্পিউটারের প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন।

পার্লারের কাজ শিখে তুলাতলী বস্তির তরুণী জান্নাতুল ফেরদৌস শিউলি আরেকজন সহযোগী নারীকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিউটি পার্লার। শিউলি সারাবাংলাকে জানালেন, দেড় বছর ধরে পার্লার চালাচ্ছেন। প্রথম দিকে আয় ভালোই ছিল। পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এখন ব্যবসা একটু মন্দা। তবুও কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন।

দিন কয়েক পরেই শিউলির বিয়ে। বস্তি থেকে বেরিয়ে বিউটি পার্লারের মতো কাজে যুক্ত হওয়ার কারণেই ‘ভালো ঘরে’ তার বিয়ে হচ্ছে— এমনটাই জানালেন শিউলি।

বিএনপিএস জানিয়েছে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন বস্তির ৭৫ জন নারীকে তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। তাদের দেখে বস্তির আরও নারী উৎসাহ পাচ্ছেন এবং নানা প্রশিক্ষণ নিয়ে আয়বর্ধক কাজে যুক্ত হচ্ছেন।

কেবল স্বাবলম্বী হওয়া বা আর্থিক সক্ষমতা অর্জনিই নয়, দৃষ্টির অগোচরে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন বস্তির একদল নারী। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সরকার যেসব আর্থিক সেবা দিচ্ছে, এই নারীরা বস্তির বাসিন্দাদের সেগুলো পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করছেন। এছাড়া পারিবারিক-সামাজিক যেকোনো ধরনের সহিংসতা রোধে আইনি সহায়তা পেতে সহায়তা দিচ্ছেন বস্তির বাসিন্দাদের, বিশেষত নারীদের।

নগরীর আমবাগান নালার পাড় বস্তির বাসিন্দা আমেনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্বামী সিএনজি ট্যাক্সি চালায়। ঘরে এসে নানা কারণে শুধু শুধু গায়ে হাত তুলত। এখন আমি প্রতিবাদ করি। স্বামীকে বোঝাই যে তুমি যেমন সারাদিন পরিশ্রম করো, আমিও তো সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করি। গায়ে হাত তোলা উচিত নয়। স্বামী উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন। একসময় উনি আমাকে ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। এখন আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু বের হলে, কোথাও একটু গেলে আপত্তি করেন না।’

ছয় মাস আগে একই বস্তিতে থাকা স্ত্রীকে মারধর করে তিন দিনের বাচ্চা নিয়ে চলে যাওয়া এক স্বামীকে নগরীর মনসুরাবাদে নারী নির্যাতন সহায়তা সেলের মাধ্যমে ধরে এনে সমস্যার সমাধান করে দেন বলে জানান আমেনা। এছাড়া অন্তত চার জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাইয়ে দিতে সরাসরি সমাজসেবা অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।

‘সরকার যে ভাতা দেয়, সেটাও তো আমরা অনেকে জানতাম না। কেউ কেউ জানলেও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে যেতেন। সেখানে দালালকে দিতে হত ২০০-৩০০ টাকা। কিন্তু বিএনপিএস আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে-কোথায় গেলে আমরা সহজে সরকারি ভাতা পাব। এখন আমরা নিজেরাই ভাতা পাওয়ার উপযোগী লোকজনকে নিয়ে সরকারি অফিসে যাই,‘— বলেন আমেনা বেগম।

 

তুলাতলী বস্তির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ মনোয়ারা বেগম জানালেন, তিনি নিজের প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্যও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করেছেন সরাসরি সরকারি অধিদফতরে যোগাযোগ করে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা কোনো দালালের কাছে যাননি। এভাবে তিনি পাঁচ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন।

একই বস্তির নিশাত আক্তার জানিয়েছেন, তিনি অন্তত ছয় জনকে মাতৃত্বাকালীন ভাতা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা দিয়েছেন। এজন্য কাউকে এক টাকাও দিতে হয়নি।

বিএনপিএস জানিয়েছে, তাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল দলনেতারা গত তিন বছরে মোট ১৬২ জনকে কোনো ধরনের হয়রানি-প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সরকারি ভাতা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন।

বিএনপিএস, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ফেরদৌস আহম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার সম্পর্কে ধারণা দিতে। যেহেতু তাদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম, তাদের এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সরকারি সেবা কোথায় ও কিভাবে পাওয়া যেতে পারে, সেই ধারণাও আমরা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অধিদফতর, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), জাতীয় মহিলা আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা— এগুলোর সঙ্গে আমরা তাদের সরাসরি যোগাযোগে সহায়তা করেছি। তিন বছর পর এসে তারা এখন অনেকটাই পরিণত এবং অধিকার সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আগল চট্টগ্রাম নারী শক্তহাতে স্টিয়ারিং

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর