দেশে ৩ কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে আলোচনা
১৭ জুন ২০২১ ০৮:৩৪
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন প্রয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের একটি ও বিদেশি দুইটি কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে আলোচনা করেছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি)। তবে শর্তসাপেক্ষে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হলেও অন্য দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে এখনও কোনো পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে বিএমআরসি কর্তৃপক্ষ। এই দুটি ভ্যাকসিনের একটি ভারতীয় ও আরেকটি চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের।
বুধবার (১৬ জুন) এক জরুরি বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান বিএমআরসি পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনার ভ্যাকসিন ‘বঙ্গভ্যাক্স’ মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দিতে আরও কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে বিএমআরসি। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তাসহ বেশকিছু বিষয় জানতে চাওয়া হবে গ্লোব বায়োটেক কর্তৃপক্ষ ও তাদের সিআরও’র কাছ থেকে।এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটির ফেইজ ওয়ান ট্রায়ালের আগে বানর বা শিম্পাঞ্জির ওপর পরীক্ষা করতে হবে। এদের ওপর টিকাগুলোর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সব কাগজপত্র বিএমআরসিতে জমা দিতে হবে।
বিএমআরসি বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দেশের গ্লোব বায়োটেক ছাড়াও ভারতের ভারত বায়োটেক আর চীনের ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল বায়োলজি অব দ্য চায়নিজ একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের (আইএমবি ক্যাম্পস) ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। গ্লোব বায়োটেকসহ এই দুই দেশের দুইটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রোববার ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক তিনটি প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ভারত বায়োটেক ও চীনের আইএমবি ক্যাম্পসের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের প্রটোকল মেনেই কাজ শুরু করতে পারবে। ভারত বায়োটেক ও আইএমবি ক্যাম্পসের ট্রায়াল করবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইসিডিডিআরবি)। তবে বৈঠকে এই দুইটি ভ্যাকসিনের বিষয়ে আলোচনা হলেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নি বলে জানান বিএমআরসি পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন।
তিনি বলেন, আজকের আলোচনার শুরুর দিকে আরও দুইটি ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক ছাড়পত্রে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া বিষয়েও আলোচনা হয়েছে কিছু সময়ের জন্য। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি।
রুহুল আমিন বলেন, দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদনের ব্যাপারে সবই পজিটিভ আলোচনা হয়েছে। দেশে ট্রায়াল চালালে আমরাই উপকৃত হব, আর তাই এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। এসব ট্রায়ালের জন্য তাই আমরা যেসব শর্ত দিয়েছি সেগুলো পূরণ করা খুব একটা কঠিন কিছু না।
তিনি বলেন, আমরা প্রত্যেক সিআরওকে চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে জানাবো। আমরা তাদের ডাকব। উনাদের কথা শোনার পর আমরা মিডিয়াকে ডেকে জানিয়ে দেব।
এর আগে ১৭ জানুয়ারি ১০ হাজার পৃষ্ঠার প্রটোকল পেপার বিএমআরসিতে জমা দেয় গ্লোব বায়োটেকের পক্ষে নিয়োজিত সিআরও প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে বিএমআরসি’র পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়, যার উত্তর গ্লোব বায়টেকের পক্ষ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হয় বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল জার্নাল ‘ভ্যাকসিন’ এ গ্লোব বায়োটেকের প্রাণীদেহে কার্যকারিতার সাফল্য নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ পায়।
উল্লেখ্য, ১ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্লোব বায়োটেক প্রথম জানায়, তারা দেশেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে জন্য কাজ করছে। ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরই তারা এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড ২০১৫ সালে ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, রক্তস্বল্পতা, উচ্চ রক্তচাপ, অটোইমিউন ডিজিজসহ অন্যান্য দুরারোগ্য রোগ নিরাময়ের জন্য বায়োলজিক্স, নভেল ড্রাগ এবং বায়োসিমিলার উৎপাদনের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক গবেষণাগার স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে গ্লোব বায়োটেক গবেষণার পাশাপাশি কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ কিট, ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কার সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করে। সিইও ড. কাকন নাগ ও সিওও ড. নাজনীন সুলতানার সার্বিক তত্ত্বাবধানে তারা ‘কোভিড-১৯’ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে গ্লোব ঘোষণা দেয়, প্রাণীদেহের ওপর এই ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের ট্রায়াল তারা সফলভাবে শেষ করেছে। পরবর্তী ধাপগুলো ঠিকঠাকমতো শেষ করতে পারলে ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে তারা টিকা বিপণন করতে পারবে। এদিন সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এই ভ্যাকসিন সম্পর্কে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফল হয়েছি। এনিম্যাল পর্যায়ে এটা সফল হয়েছে। আশা করছি মানবদেহেও সফলভাবে কাজ করবে আমাদের ভ্যাকসিন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে যাব। এরপর আমরা তাদের দেওয়া গাইডলাইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।
এর আগে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে গ্লোব বায়োটেকের ডা. আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘আমরা এর আগে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে সাফল্যের কথা আমরা গণমাধ্যমে বলেছিলাম। ওই ট্রায়ালের সাফল্যের পর আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করছি। প্রাণীদেহের উপর এই পর্বের ট্রায়ালও প্রায় শেষ। এখন ডেটা কালেকশন চলছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ ডাটা কালেকশন শেষ হতে পারে বলে আশা করছি। এই ডাটা কালেকশন শেষ হলেই সেটি বিশ্লেষণ করে আমরা আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য আবেদন করব বিএমআরসি’র কাছে। সেখানে এনিম্যাল স্টাডির তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন শেষে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আবেদন থাকবে। অনুমতি পেলে আমরা ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অরগানাইজেশনের (সিআরও) মাধ্যমে ট্রায়াল শুরু করব।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ শেষ করে বিশ্লেষণের পর মানবদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বর মাসেই শুরু করার বিষয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছিলেন ডা. আসিফ।
১ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) বিভাগের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ সারাবাংলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানান, তারা তাদের ভ্যাকসিনের নাম দিয়েছেন ‘ব্যানকোভিড’, যা মূলত ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েন্টস এম-আরএনএভিত্তিক ভ্যাকসিন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এই ঘরানার মধ্যে ‘ব্যানকোভিড’ই প্রথম ভ্যাকসিন। আর এটিই প্রাণীদেহে দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োগ করে সাফল্য মিলেছে। কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরি পরিচালিত ‘বায়ো আর্কাইভ’ সার্ভারে তাদের এ সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।
পরবর্তীতে ৫ অক্টোবর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের উদ্ভাবিত টিকা ‘ব্যানকোভিড’ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের সিইও ড. কাকন নাগ। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ব্যানকোভিড ভ্যাকসিনটি ডি৬১৪জি ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রথম ও একমাত্র আবিষ্কৃত টিকা। ইতোমধ্যে অ্যানিমেল মডেল ইঁদুরে নিয়ন্ত্রিত ও পূর্ণাঙ্গ প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ব্যানকোভিড সম্পর্ণ নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যার বিস্তারিত ফলাফল বায়ো-আর্কাইভে (biorxiv) প্রি-প্রিন্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে কন্ট্রাক্ট রিসার্স অর্গানাইজেশনের (সিআরও) সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রটোকল তৈরির কাজ করছি। আশা করছি, তারা খুব শিগগিরই বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক ছাড়পত্রের জন্য এই প্রটোকলসহ আবেদন করবেন। বিএমআসির নৈতিক অনুমোদন সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে তারা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছেও প্রটোকলস ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার জন্য আবেদন করতে পারবেন।’
১৪ অক্টোবর মানবদেহে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ‘ব্যানকোভিড’ ট্রায়ালের জন্য দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের সঙ্গে আইসিডিডিআরবি এক সমঝোতা স্মারক সই করে। ওই সময় আইসিডিডিআরবি’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আলম জানিয়েছিলেন, গ্লোব বায়োটেকের এই টিকা তিন হাজার মানুষের ওপর ট্রায়াল দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘প্রাণীদেহে ট্রায়ালের পর্যালোচনা করবে আইসিডিআরবি। তারপর মানবদেহে ট্রায়ালের জন্য মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বিএমআরসি ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন চাওয়া হবে। সেটি পাওয়ার পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে।’ তবে কবে নাগাদ ট্রায়াল শুরু হবে এমন প্রশ্নে নির্দিষ্ট কোনো সময় বলতে পারেনি গ্লোব বায়োটেক।
১৭ অক্টোবর দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ‘ব্যানকোভিড’কে তালিকাভুক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটির তালিকায় গ্লোব বায়োটেকের আবিষ্কৃত তিনটি ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই ভ্যাকসিনের নামকরণ করা হয় বঙ্গভ্যাক্স হিসেবে।
২৮ ডিসেম্বর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি দেয়।
সারাবাংলা/এসবি/এসএসএ