চট্টগ্রামে দুদক কর্মকর্তাকে বদলি নিয়ে নানা আলোচনা
১৭ জুন ২০২১ ২৩:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তাকে আকস্মিক বদলি নিয়ে নানামুখী আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়া, প্রভাবশালীদের অনিয়মের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ দেওয়া এবং স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করে চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে বেশ আলোচিত এই কর্মকর্তা। গুঞ্জন উঠেছে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই তাকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, একই কর্মস্থলে চাকরির মেয়াদ তিন বছর পার হয়ে যাওয়ায় ওই কর্মকর্তাসহ মোট ২১ জনকে বদলি করা হয়েছে।
আলোচিত ওই কর্মকর্তা হলেন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। বুধবার (১৬ জুন) বিকেলে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে জারি করা এক আদেশে শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালীতে একই পদে বদলি করা হয়। আকস্মিক এই বদলি আদেশ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জাতীয়তা ও জন্ম নিবন্ধন সনদ পাইয়ে দেওয়া, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড ও পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে গত ১৪ জুন থেকে বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) পর্যন্ত চট্টগ্রামে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলারই অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও বাদী মো. শরীফ উদ্দিন। তার অনুসন্ধানেই উঠে এসেছে, নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া একটিসহ কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে অবৈধভাবে ভোটার করা হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এসব মামলায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে আসামি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে তোলপাড় করা এই অনুসন্ধানের আগে শরীফ উদ্দিন সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানকে অবৈধভাবে ২২টি গ্যাস সংযোগ দেওয়ার একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেন। গত ৯ জুন এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন তিনি।
এতে পাঁচজনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) মো. সারওয়ার হোসেন, দক্ষিণ জোনের টেকনিশিয়ান (সার্ভেয়ার) মো. দিদারুল আলম, সাবেক ব্যবস্থাপক মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বিপনন) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ও অবৈধভাবে সংযোগ পাওয়া গ্রাহক মুজিবুর রহমান। গ্রেফতার করা হয় সারওয়ার, দিদারুল ও মজিবুর রহমানকে। এই মামলার পর কেজিডিসিএল অবৈধ ২২ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
২০১৯ সালের শেষদিকে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনিয়ন-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামেন। চমেক হাসপাতালে ২০০৮ সাল থেকে টেন্ডারের ভিত্তিতে যত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে, সবগুলোর নথি তলব করে দুদক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর ‘টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্লিনিক ব্যবসা, কমিশন ব্যবসাসহ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ’ অনুসন্ধানে নেমে এই নথি তলবের বিষয়টি প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে।
এর ধারাবাহিকতায় দুদক চমেক হাসপাতালের দরপত্র, খাবার সরবরাহ, চুক্তিভিত্তিক লোক সরবরাহ, রক্ত সঞ্চালন বিভাগের অনিয়ম, কেনাকাটাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। এর অংশ হিসেবে প্রথম দফায় এক চিকিৎসকসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। দ্বিতীয় দফায় ক্যানটিনগুলোর নানা অনিয়মের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে দুদক। অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ মেলার পর চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এ অনুসন্ধান প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে।
এর আগে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন কমপক্ষে ৭০টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করা জমি নিয়ে দুর্নীতির অনুসন্ধানও করেন শরীফ উদ্দিন। প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ৬০ জনের দালাল সিন্ডিকেটের কমিশন বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি উঠে আসে তার অনুসন্ধানে।
উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে ‘আকস্মিক’ বদলি আদেশের পর এখন দুদকের চট্টগ্রামের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এসব আলোচনা ঘুরেফিরে আসছে। প্রকাশ্যে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। তবে তাদের মধ্যে আলোচনা আছে, প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক মহলের দুর্নীতিতে ‘হাত দেওয়ায়’ রোষানলে পড়েছেন তিনি। এই অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই তাকে বদলি করা হয়েছে। আলোচনা আছে, কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই দুদক সচিবালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই বদলিতে ভূমিকা রেখেছেন। কর্মস্থলে তিন বছর মেয়াদ পার হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা একটা অজুহাত মাত্র। এর চেয়েও বেশি সময় ধরে অনেক কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে আছেন বলে তাদের অভিযোগ।
তবে এ ধরনের আলোচনায় ওঠা অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২১ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তার মধ্যে উনি (শরীফ উদ্দিন) একজন। সব ধরনের নিয়ম মেনেই বদলি করা হয়েছে। সাধারণত কোনো কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে আড়াই থেকে তিন বছর একটানা থাকলে তাকে আমরা বদলি করি। এটিই নিয়ম। সেই নিয়মেই ২১ জনকে বদলি করা হয়েছে। এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’
সারাবাংলা/আরডি/একে