ভ্যাকসিন সংকটে ঘোর অনিশ্চয়তায় দেশে আসা কুয়েত প্রবাসীরা
১৯ জুন ২০২১ ২৩:৫৯
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কুয়েত সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে বিপাকে পড়েছেন ছুটি কাটাতে দেশে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে দেশটিতে কেবল ভ্যাকসিনগ্রহীতাদেরই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। যারা ভ্যাকসিন নেয়নি, তাদের সেপ্টেম্বরের পরে ইকামা নবায়ন করা হবে না বলেও জানিয়েছে কুয়েত সরকার। কেবল ভ্যাকসিন নেওয়ার শর্ত থাকলেও হতো, এর সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোম্পানি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়াতেই গোল বেঁধেছে।
কুয়েত সরকার বলছে— ফাইজার, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন বাদে অন্য কোনো ভ্যাকসিন নিলে দেশটিতে প্রবেশ করা যাবে না। অথচ দেশে বর্তমানে এই চারটি ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিনের মধ্যে কেবল ফাইজারের একলাখ ডোজ ভ্যাকসিন রয়েছে। সেই ভ্যাকসিনে আলাদা করে কুয়েতপ্রবাসীদের কোনো ধরনের অগ্রাধিকারের সিদ্ধান্ত এখনো আলোচনার টেবিলে নেই। অন্যদিকে বয়সের কারণে অনেক প্রবাসী ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য নিবন্ধনই করতে পারেননি। ফলে এই কুয়েতপ্রবাসীদের জন্য কুয়েতে ফেরার পথে এখন পর্যন্ত কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিয়েই জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। তবে সেই ভ্যাকসিনের মজুত বলতে গেলে শেষ। এখন চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কিন্তু এই ভ্যাকসিন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না কুয়েত সরকারের কাছে। আর কুয়েত সরকার ফাইজারের ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যারা ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন, কেবল তাদেরই ফাইজারের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কুয়েতপ্রবাসীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাদের বিষয়ে সরকারিভাবে আলাদা কোনো নির্দেশনা নিলে তখন সে অনুযায়ী কাজ করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় প্রবাসীরা দাবি জানিয়েছেন, ফাইজারের ভ্যাকসিনে যেন তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো অবশ্য বলছে, তারা কুয়েতসহ সব দেশের সঙ্গেই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত যেকোনো ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলেই প্রবাসীদের ঢুকতে দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রবাসীদের ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের।
জানা যায়, চলতি বছরের ২১ মে কুয়েত সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়, ছুটিতে গিয়ে যেসব প্রবাসী এখনো ভ্যাকসিন গ্রহণ করেননি, তাদের কুয়েতে প্রবেশ করতে পারবেন না। আর এই ভ্যাকসিন অবশ্যই কুয়েত সরকারের অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিন হতে হবে। কুয়েত সরকারের অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলো হলো— ফাইজার, অক্সফোর্ড, জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্না। যারা ভ্যাকসিন নেবেন না, তাদের ইকামা নবায়ন করা হবে না।
কুয়েত ফেরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসার পরে এখন ভ্যাকসিন নিতে না পারার কারণেই অনেকে ফিরতে পারছেন না। তাদের অনেকের বয়স ৪০ বছরের কম হওয়ায় তারা নিবন্ধনই করতে পারেননি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য।
আশ্রাফ উদ্দিন (৩৯) নামে একজন প্রবাসী সারাবাংলাকে বলেন, কুয়েত সরকার পরিষ্কার বলে দিয়েছে— তাদের নির্দেশনায় উল্লেখ করা চারটি ভ্যাকসিনের কোনো একটি না নিলে দেশটিতে যাওয়া যাবে না। এই শর্তের কারণে দেশে আসা অনেকেই বিপদে পড়ে গেছে। কারণ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তা সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করে নিতে হয়েছে। কিন্তু বয়স কম থাকার কারণে সেখানে অনেকেই নিবন্ধন করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, যখন কুয়েত সরকার নির্দেশনা জানায় তখন বাংলাদেশে অক্সেফোর্ডের ভ্যাকসিন প্রায় শেষের দিকে। এখন তো নিবন্ধনও বন্ধ। সরকার বলছে, প্রবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়ে চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। কিন্তু সেই ভ্যাকসিন দিয়ে তো কুয়েতে যাওয়া যাবে না! এদিকে ইকামা’র মেয়াদও প্রায় ফুরিয়ে আসছে। তাই দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কারণ ভ্যাকসিন না নিলে তো সেপ্টেম্বর থেকে ইকামা নবায়ন করা হবে না বলে জানিয়েছে কুয়েত সরকার।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কুয়েত সরকার অনুমোদিত ভ্যাকসিন পেতে বেশকিছু কর্মসূচিও পালন করেছেন কুয়েতপ্রবাসীরা। এখন অগ্রাধিকারভিত্তিকে দেশে ফাইজারের ভ্যাকসিন পেতে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান আশ্রাফ উদ্দিনসহ অন্য প্রবাসীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি, কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণাল্যের সঙ্গে কথা বলে প্রবাসীদের ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এক্ষেত্রে আসলে আলাদাভাবে কোনো ভ্যাকসিন পছন্দের সুযোগ নেই। বিশেষ করে কোভ্যাক্স থেকে যা দেওয়া হবে ,তাই নিতে হবে আমাদের।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরাও ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে কুয়েতসহ যেসব দেশে ভ্যাকসিন ছাড়া প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হচ্ছে। যদি ম্যানেজ হয়ে যায় তবে অবশ্যই প্রবাসীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। হয়তো সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা আশা করছি সরকারের পক্ষ থেকে যে জোরালোভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে শিগগিরই আমরা ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। আপাতত চীনের যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটিই সবাইকে নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, সেভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পক্ষ থেকে যদি আলাদা কোনো দাবি থাকে, সেটিও সরকারের মাধ্যমে আমাদের কাছে নির্দেশনা আকারে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তাদের অগ্রাধিকার দিয়েই বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে তাদের কেউ যদি জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে নিজেদের পরিচয়পত্র জমা না দিয়ে থাকেন, তবে তার ভ্যাকসিন পেতে দেরি হবে। জনশক্তি ব্যুরোর মাধ্যমে যারা নিবন্ধন করবেন, তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্যাকসিন পাবেন।
এর আগে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের অনেক দেশের আগেই জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ। এই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ভ্যাকসিন ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কিনলেও কোম্পানিটির কাছ থেকে মাত্র ৭০ লাখ ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে ভারতের উপহার ছিল ৩২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। এরপর আর কোনো ভ্যাকসিন না আসায় শেষ পর্যন্ত ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এর মধ্যে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিনোফার্মের ১১ লাখ ভ্যাকসিন উপহার মিলেছে। বৈশ্বিক ভ্যাকসিন জোট গ্যাভির কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে পাওয়া গেছে ফাইজারের এক লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। এর আগে যারা নিবন্ধন করেও অক্সেফোর্ডের ভ্যাকসিন পাননি, তাদেরই মূলত এখন এসব ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর