মাহাতাব বাঁশি বাজালেই ছুটে আসে মৌমাছির ঝাঁক
২২ জুন ২০২১ ০৮:০০
যশোর: হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার গল্প কে না জানে! তার সেই মায়াবী বাঁশির সুরে গর্ত থেকে বের হয়ে এসেছিল শহরকে জ্বালিয়ে মারা সব ইঁদুর। তারপর সব ইঁদুরকে নিয়ে সাগরে ফেলে দিয়েছিল সেই জাদুকর বাঁশিওয়ালা।
গল্পের পাতার হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা নয়, এমন এক সত্যিকারের বাঁশিওয়ালাও রয়েছেন। বিদেশ-বিভূঁই নয়, আমাদেরই দেশে, এক অজ পাড়া গাঁয়ে। তবে এই বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরে ইঁদুর নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে মৌমাছি। সবাই একে ভিড় জমায় সেই বাঁশিওয়ালার শরীরে। আপাদমস্তক মৌমাছিতে ঢেকে যান সেই বাঁশিওয়ালা, আর বাজতে থাকে তার বাঁশি।
হ্যাঁ, এমনই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাবেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার হাসানপুর ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামে। আর যার করা বলা হচ্ছে তার নাম মাহাতাব মোড়ল। তিনি বাঁশি বাজালেই তার গোটা শরীর ভরে যায় মৌমাছির উপস্থিতিতে। আর সেই দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন তার বাড়িতে।
মৌমাছিদের নিয়ে মাহতাবের এমন কসরতের কারণে তার নামটাই বদলে গেছে। ‘মৌমাছি মাহতাব’ বললেই এখন সবাই চেনেন তাকে। সেই ‘মৌমাছি মাহতাব’ জানালেন, ছোটবেলায় অনেকটা শখের বশেই মৌচাক থেকে মধু আহরণ শুরু করেন। এরপর সেটিই পরিণত হয় তার পেশায়। প্রথম দিকে বালতিতে শব্দ করে ও পরে টিনের থালায় শব্দ করে চাক থেকে মৌমাছি সরানোর কৌশল রপ্ত করেছিলেন। একসময় বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছিদের নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করেন তিনি। তাতে সফলও হন।
মাহতাব সারাবাংলাকে বলেন, রাতে চাক ভাঙতে গেলে চাক থেকে মৌমাছি সরানোর জন্য বালতিতে শব্দ করতাম। পরে টিনের থালায় শব্দ করলে দেখতাম তাও আসছে। পরে একদিন মনে হলো, বাঁশি বাজিয়ে দেখি তো কাজ হয় কি না। প্রথম রাতে বাঁশি বাজানোর পর দেখলাম অল্প কিছু পোকা (মৌমাছি) এসেছে। পরের রাতে অর্ধেক সময় থালাতে শব্দ করে ও অর্ধেক সময় বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছিদের চাক থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। এরপর আস্তে আস্তে শুধু বাঁশি বাজিয়েই মৌমাছিদের চাক থেকে আমার কাছে নিয়ে আসি।
শরীরে হাজারও মৌমাছি বসলেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই মাহাতাবের। বেশ স্বাভাবিকভাবেই বাঁশি বাজিয়ে যেতে থাকেন তিনি। জানালেন, তার চেষ্টাতেই বাঁশির সুরে হাজারও মৌমাছি চাক ছেড়ে তার কাছে আসতে শুরু করে। বছরখানেক আগে থেকে শুরু করেছেন এভাবে বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছিদের আকৃষ্ট করার বিষয়টি। শুরুর দিকে কিছুটা ভয় পেলেও এখন আর মৌমাছিদের কোনোভাবেই ভয় পান না মাহতাব।
মৌমাছিদের কাছে আসার এমন দৃশ্য থেকে মধু সংগ্রহকারী এ পতঙ্গের প্রতি ভালোবাসাও জন্মায় মাহতাবের। আর তাই মৌমাছি, স্থানীয় ভাষায় পোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা হয় মাহাতাবের। সেটিতে সফল হয়েছেন তিনি।
মাহতাব বলেন, আমার একটা কল্পনা ছিল, কিভাবে পোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়। মানুষ তো বাঘ-ভাল্লুককের মতো বনের প্রাণীদের শিক্ষা দিয়ে সব কাজ করাতে পারে। বাঘের মতো একটা প্রাণী, তাকে হা করতে বললে হা করে, লাফ দিতে বললে লাফ দেয়। আমার মনে হলো, পোকও তো বনেরই। আমি চেষ্টা করে দেখব, এরা পোষ মানে কি না। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে ওরাও আমার কথা শোনে।
মাহাতাবের বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছি জড়ো করার দৃশ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন উৎসুক মানুষ। অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখে তারা অভিভূত। তাদের কয়েকজন বললেন, শুরুতে লোকমুখে মাহতাবের এমন মৌমাছি মানবে পরিণত হওয়ার বিষয়টি শুনে বিশ্বাসই করেননি। তারপরও অনেকের পীড়াপীড়িতে এসেছেন মাহতাবের বাড়ি। আর নিজ চোখে চেখেও তারা বলছেন— ‘এ অবিশ্বাস্য’।
মাহাতাবের স্ত্রী ফুলজানও বলছেন, এখন আর ভয় পান না তিনি। বরং স্বামীকে দেখতে নানা এলাকা থেকে লোকজন আসছে, সেটি উপভোগই করেন। ফুলজান বলেন, ‘উনি (মাহতাব) মধু নিয়ে আসতেন। মধুতে একটা-দু’টো পোক (মৌমাছি) থাকত। সেগুলো পরিষ্কার করতাম। প্রথম দিকে ভয় লাগত। পরে দেখি পোক আর কামড়ায় না। একসময় উনি বাঁশি বাজাইলেই পোক উনার গায়ে বসত। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ কাজ দেখতে আসায় এখন ভালো লাগে।’
সুন্দরবনসহ সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন মাহাতাব। মধু বিক্রি করেই চলে তার সংসার। আপাতত অন্য কিছুর পরিকল্পনাও নেই— জানালেন ‘মৌমাছি মাহতাব’।
সারাবাংলা/এসএসএস/টিআর