‘লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে আরও সচেতন হতে হবে’
২২ জুন ২০২১ ০১:১৮
ঢাকা: কর্মক্ষেত্রে নারী হয়রানি প্রতিরোধ ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ও গাজী গ্রুপের পরিচালক সানিয়া বিনতে মাহতাব।
এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় বলি রেইজিং অ্যাওয়ারনেসের কথা। এটা যেকোনো জায়গায় হতে পারে। প্রথমত, ভাবতে হবে এটি যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে। কর্মস্থলে হয়রানি বা নির্যাতন— যেকোনো স্থানে যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে। আর সেটি হলে অবশ্যই অভিযোগ করতে হবে। কোনোভাবেই হয়রানির শিকার ব্যক্তিকে নিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং করা যাবে না। আর বিষয়ে প্রত্যেককে সরব হতে হবে।
অনলাইন নিউজপোর্টাল সারাবাংলা ডটনেট আয়োজিত সারাবাংলা বিজক্যাফে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ এমবিএ অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় আয়োজিত অনলাইন এই অনুষ্ঠানে এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘নারী উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ’।
সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রাজনীন ফারজানার সঞ্চালনায় আলোচনায় এতে আরও অংশ নেন সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি সেলিমা আহমেদ এবং এফবিসিসিআই পরিচালক ও উইমেন অন্টাপ্রিনিওর্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়েন্ড) সভাপতি ড. নাদিয়া বিনতে আমিন।
গাজী গ্রুপের পরিচালক সানিয়া বিনতে মাহতাব বলেন, গাজী গ্রুপে আমরা যেটি এনশিউর করি— সেইফ এনভায়রনমেন্ট। আমরা এনশিউর করি যেন সে কাজ করে সেফ ফিল করে। তাহলে তার প্রোডাক্টিভিটি ভালো হবে। এছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটি, বাৎসরিক ছুটি অনেকের দরকার হয়, অনেকের দরকার হয় না। এগুলোর জন্য কিন্তু প্রমোশন বা পজিশন চেঞ্জ হয় না। সেফ এনভায়রনমেন্টেও যদি কোনো ঘটনা ঘটে, তার জন্য আমাদের এইচআর বিভাগকে এমপাওয়ার করা আছে। তারা এটা দেখবে।
তিনি বলেন, আমাদের কিন্তু এরকম নজির আছে। এইচআর যেন পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে পারে, সে ক্ষমতা তাকে দেওয়া আছে। কোনো ধরনের হয়রানির ঘটনা হলে সেটি কিভাবে শনাক্ত করা যায়, সেটি করতে গেলে যদি কোনো সহায়তা প্রয়োজন হয়— এগুলোর জন্য সব নীতিমালা রয়েছে। সব ধরনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও রয়েছে।
বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, লিঙ্গ বৈষম্যের স্বীকার নারী-পুরুষ উভয়ই হতে পারে। এই বৈষম্য বয়স, লিঙ্গ বা কাজ করার সক্ষমতা নিয়েও হতে পারে। বাসাবাড়ির কাজ প্রথাগত মেয়েদেরই করতে হবে— এটি যেমন একটি সাধারণ ধারণা, যেটি গ্রামীণ এলাকায় আরও প্রকট।
বাগেরহাটের একটি উদাহরণ দিয়ে সানিয়া বিনতে মাহতাব বলেন, আমরা ওই এলাকায় একটি গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে সুপেয় পানির অভাব থাকায় নারীদের কেবল খাবার পানি আনার জন্যই দিনে সাড়ে ছয় ঘণ্টা করে সময় ব্যয় করতে হয়। এখন যদি একজন নারীকে দিনের সাড়ে ছয় ঘণ্টা কেবল খাবার পানি আনার জন্যই ব্যয় করতে হয়, তার ওপর সেই বাসায় সিনিয়র সিটিজেন থাকলে তার দেখাশোনার বিষয়টিও আছে; তাহলে তিনি বাকি কাজ কিভাবে করবেন? তার কাজের সঙ্গে জিডিপি’র সম্পর্কটা হবে কিভাবে? সেখানে যদি কমিউনিটিভিত্তিক পানির বিভিন্ন উৎস করে দেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু নারীদের খাবার পানি সংগ্রহের জন্য এই সময় নষ্ট করতে হতো না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখনকার সময়ের চ্যালেঞ্জ আমি বলব আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি। আমি যেমন প্রকৌশল বিষয়ে পড়ালেখা করে বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে আছি। এটি একটি মেল ডোমেনেটিং ফিল্ড। অনেক সেক্সিস্ট কমেন্ট আমাদের শুনতে হয়। যেমন— ফিল্ড ভিজিটের প্রসঙ্গ উঠলেই বলা হয়, এটা তো তোমরা পারবে না। ফ্যামিলি নিয়ে কোন ইস্যু থাকলেও বলে, মেয়েদের তো এই রকম ঝামেলা। আমি একদিকে সৌভাগ্যবান যে আমি যে ওয়াটার রিসোর্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের, এখানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
কর্মজীবন ও সংসার জীবনের ভারসাম্য নিয়ে সানিয়া বিনতে মাহতাব বলেন, এটি যেকোনো কর্মজীবী নারীর জন্যই চ্যালেঞ্জ। যার ক্যারিয়ার আছে, ফ্যামিলি আছে, বাচ্চা-মা-বা-স্বামী আছে; আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে প্রোপার টাইম ম্যানেজমেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেমন কোনো একটি কাজকে প্রায়োরিটি দেই, তেমনি স্বামী বা ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও সময় ব্যয় করার ক্ষেত্রে প্রয়োরিটি দিতে হবে। অর্গানাইজড ওয়েতে প্রোপার টাইম ম্যানেজমেন্ট হলে এটি সহজ হবে।
সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ বলেন, নারীরা অনেক আগে থেকেই উদ্যোক্তা। তারা আজ নতুন করে উদ্যোক্তা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। আজকাল আনুষ্ঠানিক খাতগুলোতে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি, বেশি করে বিষয়টি চোখে পড়ছে— পার্থক্য এটুকুই।
তিনি বলেন, গ্রামের নারীরা ঘরে যখন আয় থাকত না, মুরগির ডিম কিংবা গাছের লাউটা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। সুতরাং নারীদের মধ্যে যে উদ্যোগ ছিল না, তা নয়। তবে নারীদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স, ঋণ নিয়ে ব্যবসা করার যে সুযোগ— এগুলো ছিল না। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি ছিল না। আমরা নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে আনুষ্ঠানিক একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।
উদ্যোক্তা হতে গেলে কী যোগ্যতা থাকতে হবে— এমন প্রশ্নের উত্তরে এই সংসদ সদস্য বলেন, যেকোনো উদ্যোক্তার মধ্যেই দূরদর্শিতা থাকতে হবে। সব বিষয়ে আমি যে সব কিছু জানব, তা নয়। কোনো বিষয় জানার প্রয়োজন হলে জানতে হবে, প্রশিক্ষণ নিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নারী উদ্যোক্তারা যারা যে বিষয়ে সফল হয়েছেন, তারা সে বিষয়ে জেনেই সফল হয়েছেন। আর নারী যখন কোনো উদ্যোগ নেবে, নিজেকে নারী ভাবলে হবে না। নিজেকে শুধুই একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ভাবতে হবে। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতিটাও থাকতে হবে।
ড. নাদিয়া বিনতে আমিন বলেন, বর্তমানে নারীরা কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। আমাদের অর্থনীতির ৮০ শতাংশের প্রায় ৩৫ থেকে ৪৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে নারীদের কাজের মাধ্যমে আয় হচ্ছে।
তিনি বলেন, অনেক নারীই চায় এখন সংসারে একটু স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে নিজেই উদ্যোক্তা হতে। কেউ কেউ চায় স্বাবলম্বী হতে। অনেকে অন্যের অধীনে না থেকে নিজেই নিজের বস হতে চায়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকেই ধীরে ধীরে অল্প পরিসর থেকে শুরু করে একটা সময় বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে যেসব নারী এগিয়ে আসছেন, তাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন ড. নাদিয়া। তিনি বলেন, আমাদের নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে একধরনের বিপ্লব ঘটছে। এটি আমাদের সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য তো বটেই, জাতীয় অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। যদি আমরা নারীদের নিরাপত্তা তথা কর্মস্থলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, যদি তাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি, তাহলে তারা একটি সুষ্ঠু-সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ উপহার দিতে পারবে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
এমপি সেলিমা আহমেদ ড. নাদিয়া বিনতে আমিন নারী উদ্যোক্তা বাংলাদেশ এমবিএ অ্যাসোসিয়েশন সানিয়া বিনতে মাহতাব সারাবাংলা বিজক্যাফে