জাতীয় কাউন্সিলের কথা ভুলে গেছে বিএনপি!
২৫ জুন ২০২১ ১১:৪৩
ঢাকা: ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। বিএনপির সবশেষ তথা ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল এই দিনটিতে। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরই হওয়ার কথা ছিল সপ্তম কাউন্সিল। কিন্তু ষষ্ঠ সেই কাউন্সিলের পর প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও কিন্তু সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি।
দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস ও অসুস্থতা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবনযাপন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে না থাকা— সব মিলিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার ‘বাস্তবসম্মত’ পরিস্থিতি ছিল না বিএনপির। আর চলমান এই সময়ে জাতীয় কাউন্সিলের কথা যেন ভুলেই গেছে বিএনপি। এ ব্যাপারে দলীয় পরিমণ্ডলে কোনো আলাপ-আলোচনাও নেই।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর জাতীয় কাউন্সিল আয়োজন করতে হয়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের বাধ্যবাধকতা ছিল বিএনপির। এই বাধ্যবাধকতার কথা মাথায় রেখেই ২০১৯ সালের জুনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘জাতীয় কাউন্সিলের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।’ কিন্তু সেই ‘সর্বাত্মক প্রস্তুতি’র ফলাফল গত দুই বছরেও দৃশ্যমান হয়নি কোনোভাবেই।
দলীয় সূত্রমতে, ওই সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতা মিডিয়াতে কাউন্সিল সম্পর্কে নানা রকম বক্তব্য দিলেও কাউন্সিল করার মতো সাংগঠনিক প্রস্তুতি বিএনপির ছিল না। তাছাড়া খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপির পক্ষে কোনো অবস্থাতেই জাতীয় কাউন্সিল করা সম্ভব হতো না। কারণ, কাউন্সিল ডাকতে হলে একজন আহ্বায়ক প্রয়োজন হয়। কারাগারে থেকে কাউন্সিল আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক হতে পারতেন না খালেদা জিয়া।
কাউন্সিল সম্পর্কে ওই সময় জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘ম্যাডামের চেয়ার ফাঁকা রেখে কাউন্সিল কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া কাউন্সিল ডাকবে কে? যে কেউ কি কাউন্সিল ডাকতে পারে?’
ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর কয়েক ধাপে দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান আর নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য মিলিয়ে প্রায় ৫৯৪ সদস্যের বিশাল কমিটি করে বিএনপি। তারপরও অনেকে পদ না পেয়ে পরবর্তী কাউন্সিলের জন্য অপেক্ষা শুরু করেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি। অবশ্য করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত দেড় বছর ধরে সব কিছু স্থবির হয়ে আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাউন্সিলের ব্যাপারে ২০১৯ সালেই আমরা চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিলাম। এরপরই দেখুন, বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ চলে এলো। দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন যতটুকু সম্ভব সীমিত পরিসরে দলীয় কার্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। জাতীয় কাউন্সিলের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞের কথা আপাতত ভাবা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করা হবে।’
অবশ্য কাউন্সিলের আগে ৮১টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি ঢেলে সাজাতে হবে বিএনপিকে। সেই সঙ্গে থানা ও পৌর কমিটি গঠন করতে হবে। কারণ, এসব কমিটির শীর্ষ নেতারা পদাধিকারবলে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হন। এদের ভোটেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। যদিও ঢাকার বাইরে থেকে আসা এসব কাউন্সিলররা তাদের হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার দলের চেয়ারপারসনের ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে যান।
দলীয় সূত্রমতে, ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়া নেতাদের মধ্যে কাউন্সিল নিয়ে আগ্রহ অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। তারা মনে করেন, দ্রুত আরেকটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাঙিক্ষত পদে যেতে পারবেন। যদিও জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার পদাধিকারবলে যে কাউকে শূন্য পদে বসাতে পারেন।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্তমান মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর গত দুই বছরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার ক্ষমতাবলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে পদায়ন করেছেন। এছাড়া রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আব্দুল খালেক, রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন, কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া এবং সহসাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আবু সাইদকে পদায়ন করা হয়েছে।
তবে এভাবে শূন্যপদে পদায়নের চেয়ে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরির পক্ষে বিএনপির বড় একটি অংশ। যদিও খালেদা জিয়া অথবা তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিলের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞে হাত দেওয়ার ঝুঁকিও মাথায় রাখতে হচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতাদের। কারণ, একটু এদিক-সেদিক হলেই তৃণমূল বিএনপিতে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রীতি-রেওয়াজ মেনে চলা যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের জন্য নিয়মিত কাউন্সিল, নতুন নেতৃত্ব বাছাই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেদিক বিবেচনায় দুই বছর আগেই আমাদের জাতীয় কাউন্সিল করা দরকার ছিল। কিন্তু কী কারণে করতে পারিনি, সেটা সবাই জানে। আর এখন তো কোভিড-১৯-এর কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রমই চলছে সীমিত পরিসরে। সুতরাং জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে এখন আর ভেবে লাভ নেই। পরিস্থতি স্বাভাবিক হলে কাউন্সিল হবে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর